পাতা:বঙ্গ গৌরভ - জলধর সেন.pdf/২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর SS বিপন্ন দেবেন্দ্রনাথকে অনেক হিতৈষী বন্ধু পিতৃঋণ অস্বীকার করিতে উপদেশ দিয়াছিলেন। কিন্তু ন্যায়নিষ্ঠ দেবেন্দ্রনাথ ঘূণার সহিত সে সকল প্রস্তাব উপেক্ষা করিতে দ্বিধা করেন নাই। দীন দরিদ্রের বেশ ধারণ করিয়া অতিশয় মিতব্যয়িতার সহিত সংসার চালাইয়া দেবেন্দ্ৰনাথ ধীরে ধীরে ঋণের শেষ কপদকটি পৰ্যন্ত পরিশোধ করিয়াছিলেন। র্তাহার এই ধর্মপথে চলার পুরস্কার পাইতেও বিলম্ব হয় নাই। ভগবৎকৃপায় ক্ৰমে ক্রমে আবার অগাধ ঐশ্বৰ্য সঞ্চয় করিয়া তিনি বিপুল সম্মানের অধিকারী হইয়াছিলেন। ইহার পর তিনি ধর্মের সংস্কার, উন্নতি ও প্রচার কার্যে মন দেন। প্ৰাচ্যধর্মের নিয়মপ্ৰণালী, আচার-অনুষ্ঠান সাধারণ লোকে যাহাতে সহজে বুঝিতে পারে, সেজন্য তিনি ব্ৰাহ্মধর্ম সংক্রান্ত বহু পুস্তক’ লিখিয়া রাখিয়া গিয়াছেন। তাহা ছাড়া এই সকল সম্বন্ধে সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যাও তেঁহার অঙ্ক নহে। স্বগীয় কেশবচন্দ্ৰ সেন দেবেন্দ্ৰনাথের প্রিয় এবং প্রধান শিষ্য ছিলেন। সর্বদ, সর্বত্র, সর্বাবস্থায় প্রাচীন আৰ্য ঋষিক্ষের ন্যায় দেবেন্দ্রনাথের জীবন শুদ্ধ, পবিত্র ও নির্মল ছিল। তাই লোকে তঁহকে “মহাফি” আখ্যা প্ৰদান করিয়াছিল। বস্তুত তিনি মহর্ষিদের মত আশ্রমও রচনা করিয়াছিলেন। জীবনের শেষ বয়সে নির্জন ধর্মচৰ্চার জন্য শহরের কল-কোলাহল পরিত্যাগ করিয়া বোলপুরের এক প্রান্তে এক আশ্রম রচনা করিয়া তিনি ব্ৰহ্মা-আরাধনার ব্যাপৃত হন। তঁহার এই আশ্রমই বৰ্তমানে শান্তিনিকেতন আশ্রম নামে খ্যাতি লাভ করিয়াছে। ব্ৰাহ্মধর্মের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ব্ৰাহ্মসমাজ নানা দলে বিভক্ত হইয়া পড়িতে থাকে। কিন্তু কিন্তু তাহা হইলেও এক দলের সহিত অন্য দলের শ্ৰীতির যাহাতে অভাব না। ঘটে, তজন্য দেবেন্দ্ৰনাথ একটি বাৎসরিক ব্ৰাহ্মা-সম্মিলনের ব্যবস্থা করিয়া যান। ইংরেজি ১৮৭৪ অব্দের নভেম্বর মাসে তাহারই চেষ্টায় ‘সমাদশী’** নামে একখানি পত্রিকা বাহির হয়। সেই বৎসরই তাহার গৃহে সমবেত হইয়া সমস্ত ব্ৰাহ্মা মহাসমারোহে মহাসম্মিলনের উৎসব করিলেন। ব্ৰাহ্মণ সম্প্রদায় নানা ভাগে বিভক্ত হইলেও দেবেন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্ব কোন দলের লোকই অস্বীকার করেন নাই। নিজের চরিত্রগুণে তিনি সকল দলের সমন্ত লোকেরই শ্রদ্ধা ও ভক্তির পাত্র ছিলেন। দানশীলতায় হাত অতিমাত্রায় মুক্ত ছিল। ‘বিপন্ন ব্যক্তি র্তাহার দ্বার হইতে কখনও শূন্য-হস্তে ফেরে নাই। দেশের দুৰ্ভিক্ষ, মহামারি, জলপ্লাবন-সমস্ত দৈবদুর্বপাকেই তিনি অকুষ্ঠিত ভাবে দান করিতেন। সমগ্ৰ ভারতের গৌরব দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর** দেবেন্দ্রনাথেরই পুত্র। তঁহার আর একটি পুত্র জ্যোতিরিন্দ্রনাথ* এবং একটি কন্যা স্বর্ণকুমারী দেবী** বাংলাসাহিত্যের সেবা করিয়া যশ অর্জন করিয়াছেন। আর, আজ যাহার যশ-সৌরভো সমস্ত পৃথিবী উদভ্ৰান্ত, যাহার কাব্য-প্রতিভা বিশ্বের সমস্ত কবির দীপ্তিকে স্নান করিয়া দিয়ছে, সেই রবীন্দ্ৰনাথ ঠাকুরেরও জনক আমাদের এই মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ । বাংলাদেশ মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের নিকট অজস্র ঋণে ঋণী। নানারকমের অবদানে তিনি বাংলাকে সমৃদ্ধিশালী করিয়া গিয়াছেন। তাই বাঙালি চিরদিন তঁহার নাম শ্ৰদ্ধার সহিত, আনন্দের সহিত, গৌরবের সহিত স্মরণ করবে। *