পাতা:বঙ্গ গৌরভ - জলধর সেন.pdf/৪৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কৃষ্ণদাস পাল Sዒ বিশেষত, তাহার মত দরিদ্র লোকের ছেলে যতটা লেখাপড়া শিখিয়াছে, তাহাঁই যথেষ্ট এবং তাঁহাতেই সে সেই অল্প বয়সেই পিতার দোকানের কাজ করিবার উপযুক্ত হইয়াছে। অধিক বেতন এবং বহুমূল্য পুস্তকাদি ক্রয় করিয়া দিবার সামর্থ্যও তাঁহার ছিল না। কৃষ্ণদাস যখন শুনিলেন যে, এইখানেই তাহার পাঠসমাপ্তি, তখন বালকের হৃদয়ে যে আঘাত লাগিল তাহা অবর্ণনীয়। কিন্তু পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মত প্ৰকাশ করা সেই দশ বৎসরের বালক কর্তব্য মনে করিল না। বিশেষত, বালক হইলেও কৃষ্ণদাস তাঁহাদের সাংসারিক অবস্থার কথা বুঝিতেন ; তঁহার উচ্চ শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করা যে তাহার দরিদ্র পিতার পক্ষে কষ্টকর, তাহাও তিনি জানিতেন। সুতরাং পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলা কৃষ্ণদাস সঙ্গত মনে করিলেন না। র্তাহার বিদ্যালয়-ত্যাগের কথা যখন বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষগণ জানিতে পারিলেন, তখন তাহারা কৃষ্ণদাসের পিতাকে অনুরোধ করিলেন যে, তিনি যেন কৃষ্ণদাসকে এই অল্প বয়সেই কার্যে লিপ্ত না করেন। বিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ কৃষ্ণদাসকে বিনা বেতনে স্কুলে পড়াইতে স্বীকৃত হইলেন এবং দয়ার সাগর বিদ্যাসাগর মহাশয় এই মেধাবী বালকের পুস্তকাদি কিনিয়া দিবার ভার গ্রহণ করিলেন। কৃষ্ণদাসের আনন্দের সীমা রহিল না; তিনি ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে দশ বৎসর বয়সে ইংরেজি শিক্ষালাভ করিবার জন্য ওরিয়েন্টাল সেমিনারির ইংরেজি বিভাগে প্রবিষ্ট হইলেন, এবং প্ৰাণপণে ইংরেজি অধ্যয়ন করিতে আরম্ভ করিলেন। ইহাতে র্তাহার বাংলা ভাষা শিক্ষার সুযোগ হইল না; পাঠশালার যতটুকু বাংলা শিখিয়াছিলেন, তাহাঁই তাহার একমাত্র সম্বল হইল। অবশ্য পরে তিনি বাংলা ভাষারও চর্চা করিয়াছিলেন; কিন্তু ভাল। ইংরেজি শিখিবার উপরই তাহার বেশি ঝোক পড়িয়াছিল। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে হইতে ১৮৫৩ খ্রিস্টােব্দ পর্যন্ত তিনি উক্ত বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভ করেন। এই পাঁচ বৎসরে তিনি যাহা শিখিয়াছিলেন, অন্য বালকের পক্ষে দশ বৎসরেও ততদূর শিখিবার সম্ভাবনা ছিল না; তঁহার একাগ্রতা ও অধ্যবসায়ই তাঁহাকে এতদূর শিক্ষিত করিয়ছিল। পাঁচ বৎসর এই বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের পর কৃষ্ণদাস স্কুলের পড়া ত্যাগ করেন এবং খ্রিস্টান মিশনারি মিলনি সাহেবের গৃহে গমন করিয়া ইংরেজি সাহিত্য ও দর্শনশাস্ত্ৰ পড়িতে আরম্ভ করেন। কিছুদিন পরে এখানে শিক্ষালাভও তাহার হইয়া উঠিল না, কারণ মিশনারি সাহেব সর্বদাই কৃষ্ণদাসকে খ্রিস্টধর্মের মাহাত্ম্য সম্বন্ধে উপদেশ দিতেন এবং হিন্দুধর্ম ও হিন্দু দেবদেবীর নিন্দা করিতেন। ধর্মপ্ৰাণ কৃষ্ণদাসের ইহা অসহ্য হওয়ায় তিনি মিলনি সাহেবের সংস্রব ত্যাগ করিতে বাধ্য হন। তৎপরে তিনি ডািভটন কলেজের অধ্যক্ষ রেভারেন্ড মর্গান সাহেবের নিকট কিছুদিন শিক্ষালাভ করেন। কৃষ্ণদাস পরে বলিতেন যে, মৰ্গান সাহেবের সাহচর্য লাভ না করিলে তিনি এত লেখাপড়া শিখিতে পারিতেন না। মর্গান সাহেব তঁহকে পুত্রের মত মেহ করিতেন এবং যাহাতে তিনি ইংরেজি সাহিত্য ও দর্শনে বিশেষ অভিজ্ঞতা লাভ করেন, তাহার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিয়াছিলেন। কৃতজ্ঞ কৃষ্ণদাস এ কথা সকলের নিকট মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতেন।