পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২০২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
177

কমাণ্ডারকে ডেকে পাঠালাম। তিনি আমাদের বললেন, টিক্কা খান যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনুরুদ্ধার করতে চাচ্ছে। এটা যেন হতে না দেওয়া হয়। আমি তাকে এ সম্পর্কে আশ্বাস দিলাম। আমি বললাম আমাদের জীবন থাকতে এটা হবে না। যদি তারা ফিরিয়ে আনতে পারে তবে আমি অস্ত্র জমা দিয়ে দেব। এ প্রতিজ্ঞা আমি রেখেছিলাম। টিক্কা খানের এ ইচ্ছা কোন দিন পূরণ হয়নি।

 এরপর আমার বাহিনীর সাহায্যে শালদা নদী থেকে কসবা পর্যন্ত যত ছোট ছোট রেলওয়ে কালভার্ট, ব্রীজ ছিল, তা এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়। টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ পাইলনও অনেক উড়িয়ে দেওয়া হয়, যার জন্য পাকসেনারা অনেক সময় যোগাযোগ থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ট্রাঙ্ক রোডের উপর ছোটখাট অনেক কালভার্টও গেরিলা বাহিনী পাঠিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়। খানসেনারা যখন দেশের মধ্যে সাধারণভাবে অত্যাচার চালাচ্ছিল- তখন এ দেশের কিছুসংখ্যক দালাল, রাজাকার, শান্তিবাহিনী লোকেরা যে কীর্তিকলাপ চালিয়েছে তার তুলনা নেই। পাকসেনারা অনেক আগেই এদেশ থেকে বিতাড়িত হয়ে যেত-যদি না এইসব কুলাঙ্গাররা এদের সাহায্য করতো। এই লোকেরা পাকেসেনাদের মনোবল যোগাতো। পাকসেনারা এত ভীত হয়ে গিয়েছিল যে, তারা সামান্য কুকুর দেখলে পর্যন্ত ভয় পেত। তাদের ধারণা ছিল বাঙ্গালীরা যাদুবিদ্যা জানত। সেই হেতু তারা মুক্তিবাহিনীর কীর্তিকলাপকে যাদুবিদ্যার সাথে তুলনা করতো। তারা এত ভীত হয়ে গিয়েছিল যে, তাদের উপর একটি গুলি ছুঁড়লে তারা অবিরাম গুলিবর্ষণ করতো, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা ভাবত মুক্তিবাহিনী চলে গেছে। এই ঘৃণ্য দালালেরা পাকসেনাদের কাছে মেয়ে পাঠাতো তাদের লালসা চরিতার্থ করার জন্য। এই সমস্ত পশুদের অপরাধ পাকিস্তানী সেনাদের চেয়ে কমতো নয়ই, বরং বেশী। এদের কিছু কীর্তিকলাপ তুলে ধরছি। একবার এক বুড়ো পাকিস্তানীমনা লোক তার ১৬ বছরের নাতনীকে পাকিস্তানী সেনাদের কাছে বিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছিল। আমরা এ খবর পেয়ে হঠাৎ করে তার বাড়ি ঘেরাও করে মেয়েটিকে উদ্ধার এবং বুড়োকে শাস্তি প্রদান করি।

 একবার দু'জন রাজাকার এক বিবাহিতা যুবতীর (সে পাকসেনাদের হাত থেকে পালিয়ে আসবার জন্য ভারতে চলে আসছিল) উপর পাশবিক অত্যাচার চালাবার জন্য তাকে ধরে ফেলে এবং তার ছ'মাসের বাচ্চা ছেলেকে পাটক্ষেতে ফেলে দেয় এবং তার উপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। আমরা এই ঘৃণ্য অপরাধের জন্য পরে তাদের ধরে এনে শাস্তি প্রদান করি। এদের নিষ্ঠুর অত্যাচারের ফলে বাচ্চা ছেলেটি মারা যায়। এক গ্রামের দরজির তিনটি বউ ছিল। সে পাকসেনাদের আমন্ত্রণ জানাত নিজ বাড়িতে এবং বউদের অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করত। সে মুক্তিবাহিনীর খবরাখবর পাকসেনাদের নিকট জানাত। আমি এ খবর জানতে পেরে তাকে ধরে এনে শাস্তি দেই।

 অনেক নিরীহ শান্তিপ্রিয় লোক ভারতে চলে যেতো পাকসেনাদের হাত থেকে মুক্তি পাবার জন্য। কিন্তু এই দস্যুরা এই নিরীহ জনসাধারণের উপর অত্যাচার চালাত। তাদের জিনিসপত্র কেড়ে নিত। এই রকম চার দস্যুকে আমরা ধরে শাস্তি দেই এবং তাদের মধ্যে একজন হিন্দুও ছিল।

 এখানে উল্লেখযোগ্য যে, কিছু পাকিস্তানী দালাল শরনার্থীর বেশে ভারতে আসত এবং আমাদের খবর নিয়ে যেত। আমরা এ খবর জানার পর সতর্ক হয়ে কিছু সন্দেহভাজন লোকের উপর তল্লাশি চালাই। তাতে দেখা যায়, অনেক দালাল চালের মধ্যে গ্রেনেড, বস্তার মধ্যে গ্রেনেড এবং অন্যান্য উপায়ে নানা ধরনের ধ্বংসাত্মক জিনিস নিয়ে আসত আমদের ক্ষতি করবার জন্য। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, এক মহিলার উপর তল্লাশি চালিয়ে দেখা যায় যে, সে লাউয়ের ভিতরে গ্রেনেড নিয়ে এসেছে।

 এইসব ঘৃণ্য দালালদের কীর্তিকলাপ যে কত জঘন্য ছেল তা বলবার নয়। তারা পাকসেনাদের মনোবল বাড়াবার জন্য যা করেছে, তা পাকিস্তানী সেনাদের থেকেও ঘৃণ্য। অনেক রাজাকার গ্রামে গ্রামে ডাকাতি করত। আমি আমার বাহিনীর লোকেরা যাতে নিরীহ জনসাধারণের কোন ক্ষতি না করে তা লক্ষ্য রাখতাম। কেউ কোন