ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট শীতলক্ষ্যার পশ্চিম পাড় গাঁও এবং বালু নদীর পশ্চিম পাড়ে ডেমরার পেছনে ছিল। সেক্টর ট্রুপস বাসাবোর আশপাশে। ১৪,১৫ এবং ১৬ই ডিসেম্বর যুদ্ধ হয়। ১৬ই ডিসেম্বর বেলা প্রায় ১০টা থেকে ডেমরা ঢাকা রোড আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল। ডেমরাতে পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রায় অবরোধ অবস্থায় ছিল। ১৬ই ডিসেম্বর সকাল থেকেই কথা হচ্ছিল যে পাকিস্তানী সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করবে। কিন্তু বেলা বারোটা পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত থাকে। বেলা সাড়ে বারোটায় পাকিস্তানীরা ডেমরা-ঢাকা সড়কের উপর অস্ত্র সংবরণ করে। ডেমরা-ঢাকার যুদ্ধে পাকিস্তনীরা যদিও ফ্রেশ ট্রুপস (সীমান্ত এলাকায় সৈনিকরা ঢাকা আসার আগেই অবরোধ অবস্থায় ছিল এবং ঢাকাতে অবস্থানরত সৈনিকরা ঐ দিন পর্যন্ত কোন যুদ্ধে লিপ্ত হয় নাই, তাই যুদ্ধক্লান্ত ছিল না)। ব্যবহার করেছিল, কিন্তু তবুও তারা বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি এ জন্য যে, তাদের নিকট দূরপাল্লায় কামান ছিল না। সে গুলোর প্রায় সবগুলোই সীমান্ত এলাকায় ছিল। কিন্তু অপরদিকে ভারতীয় ট্যাংক এবং দূরপাল্লার কামান ঢাকার আশপাশে আনতে সক্ষম হয়েছিল। আমাদের তরফ থেকে আমরা বরপার কাছে ফিল্ড গানগুলোর সাহায্যে ঢাকা শহর এবং ডেমরাতে গোলাবর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল। এখানে বলে রাখা দরকার যে, আগরতলা থেকে ঢাকা শহর পর্যন্ত আমাদের অভিযানে বিশেষ করে আমার এস ফোর্স কোন যানবাহন পায়নি। তাই সমস্ত রাস্তাটুকু তাদের পায়ে হেঁটে আসতে হয়েছিল। পায়ে হেঁটে আসতে হয়েছে ঠিকই তবুও তারা ক্লান্তি অনুভব করছিল না। করণ তারা সবাই জানতো যে পাকিস্তানীদের পতন হচ্ছে এবং ঢাকার পতন অত্যাসন্ন। আমরা আগরতলা থেকে যখন অগ্রসর হই, তখন অস্ত্র শস্ত্র গোলাবারুদ ছাড়া আর কিছুই আমাদের সাথে আনিনি এবং অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ সবগুলোই জনসাধারণ ঢাকা পর্যন্ত বহন করে নিয়ে এসেছিল। শুধু আমাদেরই নয়, ভারতীয় সেনাবাহিনীর অস্ত্রশস্ত্রও এভাবে করে আনা হয়।
৬ই ডিসেম্বর থেকে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত এ দশ দিন আমরা কোন প্রকার রসদ সাথে বহন করিনী। কিন্তু এক বেলাও না খেয়ে থাকিনি। আমাদের খাবারের ব্যবস্থা জনসাধারণ করেছিল। আমাদের খাবারের ব্যবস্থার কথা কাউকে বলতেও হয়নি। কোন কোন জায়গায় এমনও হয়েছে যে, খাবারের প্রস্তুতির দেরী দেখে আমরা সামনে অগ্রসর হয়েছি এবং জনসাধারণ পরে পেছনে থেকে মাথায় করে চার পাঁচ মাইল দূর পর্যন্ত খাবার বহন করে নিয়ে এসেছে আমাদের খাওয়ানোর জন্য।
১৬ই ডিসেম্বর বেলা প্রায় দুটায় ডেমরাতে পাকবাহিনী আমাদের বাংলাদেশে-ভারত যৌথ কমাণ্ডের কাছে অস্ত্র সংবরণ করে। ঐ সময় আমাকে সংবাদ দেয়া হয় যে, বেলা সাড়ে তিনটায় আমি যেন ঢাকা বিমান বন্দরে উপস্থিত থাকি। কারণ সে সময় লেঃ জেনারেল অরোরা আসছেন এবং লেঃ জেনারেল নিয়াজীও সেখানে উপস্থিত থাকবেন। আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমি যেন উপস্থিত থাকি। যদিও ডেমরাতে পাকসেনা আত্মসমর্পণ করেছিল তবুও ডেমরা ও ঢাকার মধ্যবর্তী এলাকা মাতুয়াইলে তখনো পাকসেনারা তাদের অবস্থান রক্ষা করছিল। বেলা তখন প্রায় ২টা। আমাকে সাড়ে তিনটায় বিমানবন্দরে উপস্থিত থাকতে হবে। তাই ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের কমাণ্ডার মেজর মইনকে ব্যাটালিয়ন নিয়ে ঢাকা চলে আসার নির্দেশ দেই। পাকিস্তানী ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার কর্নেল খিলজীকে বলি যে, আমাকে ঢাকা বিমানবন্দরে যেতে হবে। এবং তোমার সৈনিকরা যারা মাতুয়াইলে আছে তাদেরকে তুমি গোলাগুলি বন্ধ করতে নির্দেশ দাও। আমরা একই জীপে ডেমরা থেকে মাতুয়াইলের দিকে যাই এবং কর্নেল খিলজীকে আগে পাঠিয়ে দেই সে যেন তার সৈনিকদের নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে। সৈনিককে নিয়ন্ত্রণে আনতে খিলজীকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। অবশেষে সে তার সৈনিকদের আত্মসমর্পণ করাতে সক্ষম হয়।
মাতুয়াইলে আত্মসমর্পণের পর আমি এবং ডেল্টা সেক্টর কমাণ্ডার ব্রিগেডিয়ার সাবেক সিং ঢাকা বিমানবন্দর অভিমুখে রওয়ানা হই এবং সাড়ে তিনটার মধ্যে আমরা বিমানবন্দরে পৌঁছে যাই। বিমানবন্দরে পৌঁছে দেখতে পাই যে, সেখানে জেনারেল নিয়াজী এবং ভারতীয় ইস্টার্ন কমাণ্ডের জেনারেল জেকব, জেনারেল স্বাগত সিং, জেনারেল নাগ্রা ও আরো অনেকে উপস্থিত রয়েছেন। আমি বিমান বন্দরে পৌঁছে তাদের সাথে কথাবার্তা বলি