আমরা সাধারনত রাত্রিবেলায় চলাফেরা করতাম। দিনের বেলায় কোন জংগলে অথবা গ্রামের নির্জন বাড়িতে শিবির করতাম। এবং সব সময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতাম যাতে পাকবাহিনী আমাদেরকে আক্রমন করলে আমরা তার মোকাবেলা করতে পারি। এভাবে দুদিনে ৮০ মাইল পথ পেরিয়ে প্রায় ৩০০ লোকের একটা গেরিলা দল নিয়ে আমরা মঙ্গলা পোর্টের কাছে কৈলাশখালী গ্রামে আমাদের শিবির স্থাপন করি।
কৈলাশখালী গ্রামে লোকজন বেশী ছিল না। অধিকাংশ বাড়ছিল পরিত্যাক্ত। আমরা সুন্দরবনের ধারে এক হিন্দু ভদ্রলোকের বাড়িতে আশ্রয় নিই। আর অন্যান্য স্থলবাহিনী ছেলেদেরকে আমরা কয়েক ভাগে ভাগ করে পরিত্যাক্ত বাড়িতে রাখি, যাতে আমাদের উপর হঠাৎ পাকসেনা আক্রমন করলে সুবিধা করে উঠতে না পারে।
কৈলাশখালী গ্রামে একদিন বিশ্রামের পর আমি ও আমার বন্ধু শামসুল আরেফিনসহ আমরা মঙ্গলা পোর্টে ‘রেকী' করার জন্য যাই ছোট এক নৌকাযোগে। ঐ সময় খিজির নামে এক মুক্তিযোদ্ধার সংগে আমাদের পরিচয় হয়। মঙ্গলা পোর্ট-এর নিকট সে আগে থেকেই গেরিলা তৎপরতা চালাচ্ছিল। আমাদের পেয়ে সে আরও সাহস অর্জন করলো। খিজির ওখানকার বাসিন্দা হওয়ায় আমাদের রাস্তাঘাট চলাচলে সুবিধা হয়েছিল। আরেফিন আমি খিজির ও নৌকা চালানোর জন্য আরও কয়েকজন ছেলেসহ আমরা ঠিক সন্ধ্যার আগে মঙ্গলা পোর্ট ‘রেকী করে আসি। পরদিন আমরা সন্ধ্যার সময় বড় বড় ছ'খানা নৌকায় মঙ্গলা পোর্টের কাছে এসে উঠি। স্থলবাহিনীকে আমরা তিন জায়গায় পজিশন মত বসিয়ে রাখি। যদি কোনরূপ আক্রমন হয় তারা পাল্টা জবাব দেবে। অবশ্য আরেফিন সাহেব এসব বন্দোবস্ত করেন। আমি আমার নৌ কমাণ্ডো ছেলেদেরকে বুকে বাধা মাইনসহ বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে নিজে এক দলসহ নদীতে সাতার দেই। আমাদের সংগে থাকতো শুধু ছোট একটি ছুরি, একজোড়া ফিন আর একটা লিমপেট মাইন। আর গ্রুপ লিডারের কাছে থাকতো একটি অথবা দুটি করে হাতবোমা। কোন জাহাজে চারজন, কোন জাহাজে ছজন এইভাবে ভাগ করা ছিল। আমার সংগে ছিল চারজন। আমার যে জাহাজটাতে মাইন লাগানোর কথা তা নদীর অপর প্রান্তে বাধা ছিল। যাদের টার্গেট নিকটবর্তী ছিল তারা সেখানে তা লাগিয়ে যে যার মত নিজেকে নিয়ে কেটে পড়ে। আমার জাহাজে যখন পৌঁছি তখন আমার একজন ছেলে তীব্র স্রোতের মধ্যে আমাদের দল ছাড়া হয়ে যায়। আমি ডুব দিয়ে জাহাজের গায়ে যখন মাইন লাগাচ্ছিলাম, তখন অন্য দল দ্বারা পূর্বে লাগানো মাইন বাস্ট হয়ে নদীর মধ্যে জাহাজ ডুবতে শুরু করেছে। আমি দ্রুত আমার কাজ শেষ করে অন্য ছেলে দুটিসহ ফিরে আসার চেষ্টা করি। এমন সময় জাহাজ থেকে খুব জোরে হুইসেল বাজানো আরম্ভ হয়। অনবরত এস ও এস (সেভ আওয়ার সোল) সংকেত ধ্বনি হতে থাকে। সংগে সংগে বন্দররক্ষী বাহিণী আমাদের লক্ষ্য করে নদীর মধ্যে গুলি ছুড়তে শুরু করে। নদীর মধ্যে বৃষ্টির গুলি চলছে। আমাদের মোতায়েন স্থলবাহিনীও পাল্টা জবাব দিচ্ছে। উভয়পক্ষে ভীষন রকম গোলাগুলি। নদীর উপরে আকাশ লালে লাল। সমস্ত বন্দরের আলো নেভানো। আমি আমার দলসহ নদীর কিনারায় আসতেই আমার উপর উঠে পড়ে একটি ছোট উদ্ধারকারী লঞ্চ। লঞ্চটির আলো বন্ধ ছিল। আর আমি উল্টাভাবে সাতার দিচ্ছিলাম। আমার মাথায় লঞ্চটি জোরে আঘাত করে। জোরে আঘাত পাওয়ায় আমার জ্ঞান হারানোর অবস্থা হয়। আমি তখন জোরে ডুব দিয়ে নিজেকে রক্ষা করার জন্য শ্রোতের অণুকুলে পানির নিচে চলতে আরম্ভ করি। জাহাজের নিচ থেকে নিজেকে রক্ষা করার পর পানির উপর ভেসে উঠে আমার কোন সংগী পেলাম না। তখন একা একা স্রোতের প্রতিকূলে গা ভাসিয়ে সাতার কাটতে থাকি। রাত্রি প্রায় তিনটার সময় আমার পায়ের নিচে মাটি লাগে তখন আমি সাতার ছেড়ে বুকে ভর দিয়ে নদীর কিনারায় উঠে বসি। এমন সময় আমার কানের পাশ দিয়ে শো শো শব্দে গুলি চলে যায়। আবার মাটিতে শুয়ে পড়ি। লক্ষ্য করে দেখি আমার থেকে মাত্র বিশ ত্রিশ গজ দুরে পাকসেনাদের বাংকার। ওর মধ্য থেকে অনবরত আমার দিকে গুলি আসছে। কোন উপায় না দেখে আমার কোমর থেকে শেষ গ্রেনেডটি বার করলাম। গ্রেনেডের চাবি দাত দিয়ে খুলে ফেললাম এবং জোরে বাংকারের মুখ লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলাম এবং নিচের দিকে গড়িয়ে পড়লাম। আমার গ্রেনেড শব্দ করে ওঠার সংগে সংগে বাংকার থেকে গুলি ছোড়া বন্ধ হয়ে যায়। আমি তাড়াতাড়ি উঠে আমাদের নৌকা যেদিকে ছিল