পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৩৬

বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করব, যুদ্ধ করব এবং যেমন করেই হোক নিজের প্রাণের বিনিময়ে হলেও মাতুভূমিকে এই পশুশক্তির কালো হাত থেকে রক্ষা করব। সবাই আমাকে সমস্ত সামরিক ও বেসামরিক কার্যকলাপের প্রধান বলে মেনে নিলেন। আমিও নির্দেশ জারী করলাম যে, সেই থেকে আমার নির্দেশ মতই সবাইকে আপন আপন কাজ সমাধা করতে হবে। সমস্ত সিদ্ধান্তের পর আমি সমস্ত সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের সমভিব্যহার আমার উইং-এর কোয়ার্টার গার্ডে বাংলাদেশের পতাকা সসম্মানে উত্তোলন করে ওটাকে জাতীয় অভিবাদন দিলাম। এটা যে একটা কত বড় জীবনের ঝুঁকি, বিশেষ করে যখন কোন রকম সংযোগবিহীন অবস্থায় বিনা নির্দেশে এবং আর কেউ বিদ্রোহ করেছে কিনা, সেটা না জেনেই সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত চেতনায় পাক্তিস্তান সেনাবাহিনীর মত একটা এতবড় শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যে কত বড় চ্যালেঞ্জ, বিজ্ঞজন মাত্রেই তা অনুধাবন করতে পারবেন।

 তারপর আমি আমার সৈন্য ও ভারী অস্ত্র নানা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অবস্থান করানো এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করা ইত্যাদি সামরিক ও বেসামরিক নির্দেশ দানে প্রায় অর্ধারাত অতিবাহিত করি। ইতিমধ্যে অয়ারলেস মারফত সীমান্তের আমার সৈন্যদেরকেও অবস্থা বর্ণনা করে সজাগ থাকতে নির্দেশ দিই। এই ভাবে অতিবাহিত হল ২৬শে মার্চ।

 ২৭শে মার্চ সকাল ৭ ঘটিকায় মাসলিয়া বিওপি কোম্পানী হেডকোয়ার্টার থেকে কোম্পানী কমাণ্ডার সুবেদার আব্দুল মজিদ মোল্লা অয়ারলেস মারফত জানালেন যে ক্যাপ্টেন সাদেক তিনজন সৈনিকসহ যশোর থেকে সীমান্ত রাস্তা দিয়ে মাসলিয়া বিওপিতে প্রবেশ করেছে। আমি তাকে ক্যাপ্টেন সাদেরকর উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখবার নির্দেশ দিলাম। খবরটা পেয়ে আমি অনুমান করেছিলাম যে, হয়তবা ২৬শে মার্চ ভোর ৪টা পর্যন্ত কুষ্টিয়া থেকে আসতে পারিনি লক্ষ্য করেই বোথ হয় ক্যাপ্টেন সাদেক ভেবেছিল যে, সীমান্তের সৈন্যদেরকে নিশ্চয় কোন রকম সজাগ থাকার আদেশ দেওয়া হয়নি। তাই তার মাসলিয়া যাবার উদ্দেশ্য সৈন্যদেরকে চতুরতার সাথে নিরস্ত্র করা।

 যাই হোক, প্রায় ১০ মিনিট পর সুবেদার মজিদ মোল্লা জানান যে, ক্যাপ্টেন সাদেম আদেশ পালন না করার অপরাধে একজন বাঙ্গালী সিপাই-এর উপর পিস্তলের গুলি করে যশোর অভিমুখে জীপে করে পালিয়ে যায়। অবশ্য, এরপর আমার নির্দেশ অনুসারে পরবর্তী বিওপিতে খবর দিয়ে গুলির বিনিময়ে তাদের গতি রোধ করা হয়। গোলাগুলিতে ক্যাপ্টেন সাদেক ও তার সঙ্গীরা মারা যায়। কিছুক্ষণ পর সুবেদার মজিদ মোল্লা অত্যন্ত ভীতস্বরে অয়ারলেসে আমাকে এ খবর জানায়। আমি তাকে অভয় দিয়ে মৃদদেহগুলি পুঁতে ফেলার আদেশ দিই। এইখানেই শুরু হল আমার এলাকায় পদ্মার ওপারে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হনন পর্ব। এখানেই বুঝতে পারলাম- “I am in a point of no return. Either I have to kill the enemy or get killed.”

 কুষ্টিয়া পুনর্দখলের পরিকল্পনাঃ ডাঃ আসহাবুল হক সাহেবকে খবর দিলাম। দুই কমরেড মিলে ছক আঁকলাম-কুষ্টিয়া আমাকে পুনরুদ্ধার করতেই হবে। পরিকল্পনা করলাম পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। সীমান্তের সৈন্যবাহিনীকে জরুরী ভিত্তিতে চুয়াডাঙ্গায় জমায়েত হবার নির্দেশ দিলাম। ফিলিপনগর কোম্পানীকে একটা নির্দিষ্ট সময়ে কুষ্টিয়া শহরের অদূরে একটা নির্দিষ্ট স্থানে সমবেত হবার পর পরবর্তী আদেশের অপেক্ষা করতে নির্দেশ দিলাম। এই কোম্পানীর কমাণ্ডার ছিলেন সুবেদার মোজাফফর আহমেদ (বর্তমানে লেঃ ইপিআর)। দুই কমরেড মিলে ঐ এলাকার নামকরণ করলাম-”সাউথ ওয়েষ্টার্ন কমাণ্ড দক্ষিণ পশ্চিম রণাঙ্গন।” কমাণ্ডার হলাম আমি মেজর মোহাম্মদ আবু ওসমান চৌধুরী (বর্তমানে লেঃ কর্নেল)।

 এখানে কুষ্টিয়ার শত্রুর সৈন্যসংখ্যা ও তাদের শক্তির উপর কিছুটা আলোকপাত করা দরকার। যশোর ব্রিগেড থেকে ২৭ বেলুচ রেজিমেণ্ট তথা রিকনাইসেন্স ও সাপোর্ট ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানী-অর্থাৎ প্রায় ২০০ সৈন্য কুষ্টিয়া অধিকার করে ২৫/২৬শে মার্চ রাত দেড়টায়। তাদের সাথে ছিল পর্যাপ্তসংখ্যক ১০৬ এমএম আর-আর (জীপে সংস্থাপিত) চীনা এইচ-এম-জি, এলএমজি, এসএমজি ও অটোমেটিক রাইফেলসমূহ। তার সাথে