পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৭৮

জয়োল্লাসে মেতে উঠল। তারা নিশ্চিন্ত মনে পাক-সৈন্যদের বন্দী করবার জন্য এগিয়ে গেল। কিন্তু এটা যে ওদের ছলনা মাত্র, একটু বাদেই তা বুঝতে পারা গেল। ওরা অপ্রস্তুত অবস্থায় কাছে এগিয়ে আসতেই জঙ্গীবাহিনীর মেশিনগানগুলি তাদের লক্ষ্য করে একসঙ্গে গর্জে উঠল। ফলে মুক্তিবাহিনীর বহু লোক হতাহত হল। ওদের মর্টারগুলি একসঙ্গে অনর্গল অগ্নিগোলক উদগীরণ করে চলেছে। এর প্রত্যুত্তর দেবার মত উপযুক্ত অস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হাতে ছিল না। সেই অগ্নিবর্ষণের ফলে তারা পতঙ্গের মত পুড়ে ছাই হতে লাগল। এরপর তাদের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার আর উপায় রইল না। তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পারল পালিয়ে গেল। একটানা ছত্রিশ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর খুলনা শহরের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটল। এই যুদ্ধে বহু পাক-সৈন্য হতাহত হয়। তাদের মধ্যে একজন মেজর মারা যান এবং খুলনা সেক্টরের সেক্টর কমাণ্ডার কর্নেল শামস গুরুতরভাবে আহত হন।

খুলনার মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব

 খুলনা শহরের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্ব শেষ হয়ে গেলেও ছাত্ররা প্রতিরোধ সংগ্রাম থেকে নিবৃত্ত হয়নি। ২৬শে মার্চ থেকে শুরু করে ২রা এপ্রিল পর্যন্ত তারা গোপনে নানা জায়গায় পজিশন নিয়ে পাক-সৈন্যদের উপর ইতস্তত চোরাগোপ্তা আক্রমণ চলিয়ে যাচ্ছিল। এইভাবে তারা বেশ কয়েকজন সৈন্যকে হত্যা ও জখম করতে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু একথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, এই গুপ্ত আক্রমণ চালাবার কালে কোন ছাত্র মারা যায়নি বা শত্রুর হাতে ধরা পড়েনি।

 ২৮শে মার্চের যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনী যোদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু তাই বলে তারা হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেয়নি। শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ করবার জন্য তারা বাগেরহাটে গিয়ে মিলিত হোল। বাগেরহাটে প্রাক্তন সামরিক অফিসার মেজর জলিল ইপিআর ও পুলিশের লোকদের নিয়ে এক মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। খুলনা থেকে যারা বাগেরহাট গিয়েছিল তারা মেজর জলিলের বাহিনীর সঙ্গে যোগ দিল। ফলে এদের সংখ্যা দাঁড়াল সাতাশ। মেজর জলিল কোন দিকে নতুন করে আক্রমণ করা যায় সেই পরিকল্পনা রচনা করে চলেছেন।

 খুলনা শহর শত্রুপক্ষের অধিকারে থাকলেও সেখানকার কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী শত্রুদের দৃষ্টির আড়ালে গোপনে গোপনে কাজ করে চলছিলেন। সেই অবস্থাতেই তাঁদের প্রাণপ্রিয় শহরটিকে তাঁরা শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত করতে পারবেন, এই আশা বা পরিকল্পনা তাঁদের ছিল না। তবু শত্রুপক্ষকে অতিষ্ঠ করে তোলবার জন্য এবং প্রচারকার্যে সুযোগ লাভের জন্য আরও একটা ঘা মারবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এটিকে খুলনা শহরের মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব বলা চলে। শত্রু অধিকৃত শহরের বুকের উপর দাঁড়িয়ে যে নতুন আক্রমণ চালানো হয়েছিল, তা থেকে তাঁদের দুঃসাহস ও রণকৌশলের পরিচয় পাওয়া যায়।

 জনৈক সুপরিচিত স্থানীয় নেতা এই পরিকল্পনাটি রচনা করেন এবং তাকে বাস্তবে রূপান্তরিত করেন। তিনি খুলনা শহর থেকে চলে গেলেন বাগেরহাটে। তারপর সেখানে মেজর জলিলের সঙ্গে তাঁর এই নতুন পরিকল্পনা নিয়ে পরামর্শ করলেন। মেজর জলিল তাঁর এই পরিকল্পনাকে অনুমোদন ও সমর্থন করার পর তিনি তার বাহিনী থেকে ১১০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেন।

 এই মুক্তিযোদ্ধারা রাত্রির অন্ধকারে অতি সঙ্গোপনে খুলনা শহরে এসে প্রবেশ করলেন। পাক সৈন্যবাহিনীর কর্তারা এমন যে ঘটতে পারে সে কথা কল্পনাও করতে পারেনি। যুক্তিযোদ্ধারা জীবনের মায়া ছেড়ে দিয়েই এই দুঃসাহসিক কাজে পা বাড়িয়েছিল। গভীর রাত্রিতে তারা শহরের বেতার ঘাঁটি আক্রমণ করল, তারা স্থায়ীভাবে বেতার ঘাঁটি নিজেদের দখলে রাখতে পারবে, এই দুরাশা তাদের ছিল না। তাদের উদ্দেশ্য ছিল একটি দিনের