পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৬৯

জন পাকসেনা। ধ্বংসপ্রাপ্ত যানবাহনের সংখ্যাও ছিলো প্রচুর। ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি জীবন বাঁচাবার জন্যে তখন প্রাণপণে ছুটেছিলেন পাহাড়ের দিকে। কয়েকজন সঙ্গীও তাকে অনুসরন করলো। ভীতসন্ত্রস্ত সৈনিকরা হাতিয়ার, যানবাহন এবং অন্যান্য জিনিসপত্র ফেলেই প্রাণপণে ছুটছিলো। শত্রুপক্ষের পিছনের অংশ যারা আমাদের অস্ত্রের আওতার বাইরে ছিলো তারা সঙ্গে সঙ্গেই সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিয়ে পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করলো। এক ঘণ্টারও বেশী সময় এই গুলি বিনিময় চললো। ইতিমধ্যে পাকিস্তানীদের মর্টার বহর শুভপুর সেতু অতিক্রম করে তাদের অগ্রবর্তী দলের সঙ্গে যোগ দিলো। এই সময় আমাদের সেনারা প্রায় ৩ মাইল সরে এসে পরবর্তী অবস্থানে প্রস্তুতি গ্রহণ করলো। এই ভয়াবহ সংঘর্ষে ইপিআর-এর ৫ জন গুরুতরভাবে আহত হয়।

 কুমিল্লায় শত্রুর বিরুদ্ধে ইপিআর সেনাদের এই এ্যামবুশ ছিলো আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে এই প্রথম সরাসরি আক্রমণ। কুমিরার ঘটনার গুরুত্ব এতই সুদুরপ্রসারী ছিলো যে, এই ঘটনা পাকিস্তানী সৈন্যদের চট্টগ্রামে অবাধে কিছু করার মূল পরিকল্পনা ব্যাহত করে দেয়। চট্টগ্রামে শত্রুদের লোকবল পর্যাপ্ত ছিলো না বলে কুমিল্লা থেকে লোকবল বৃদ্ধি ছিলো একমাত্র ভরসা। এই এ্যামবুশের পরে আমরা একটি অয়্যারলেস বার্তা শুনে ফেলি। চট্টগ্রামের জনৈক কমাণ্ডার ঢাকায় ৯৪ ডিভিশনের কর্নেল ষ্টাফ হেডকোয়ার্টারের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তিনি বলছিলেন, আমাদের অনেক লোক হতাহত হয়েছে। সীতাকুণ্ডের দক্ষিণে বাকি সৈন্যরা আটকা পড়ে আছে। বিমানে সৈন্য পাঠানোর অনুরোধ করছি। জরুরি ভিত্তিতে বিমানে করে হতাহতদের সরাবার ব্যবস্থা করা দরকার।

 কুমিল্লায় আমারও কিছু লোক হতাহত হয়েছিলো। আমারও প্রয়োজন ছিলে নতুন সৈন্যের, অস্ত্র এবং গোলাবারুদের। সেই মুহূর্তে সীমান্ত এলাকা থেকে যে সব ইপিআর সৈন্য আসছিলো তারাই ছিলো আমার প্রধান ভরসা।

 ২৬শে মার্চ ভোর নাগাদ ক্যাপ্টেন হারুন শহরের পাঁচ মাইলের মধ্যে এসে পড়লেন। তাঁর সৈন্যরা উচ্চ কণ্ঠে “জয়বাংলা” শ্লোগান দিতে দিতে আসছিলো। কিন্তু শহরের উপকণ্ঠে এসেই থামতে হলো তাদেরকে। কয়েকজন সৈন্যকে শহর ছেড়ে কালুরঘাট সেতুর দিকে যেতে দেখা গেলো। কিছুক্ষণের জন্য ক্যাপ্টেন হারুন বিভ্রান্ত হয়ে পড়লেন। ভাবলেন “শত্রুরা কি তাহলে পুরোপুরি শহর দখল করে ফেলেছে?” এই ভাবনা তাঁকে কিছুটা হতবুদ্ধি করে দেয়। পরে দেখা গেলো যে, এরা বেঙ্গল রেজিমেণ্টাল সেণ্টার এবং ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লোক। তারা সবাই পটিয়ার দিকে যাচ্ছিলো। শহরে ঢোকার আগে আরো নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি কালুরঘাট ব্রিজ পেরিয়ে মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তাঁকে কালুরঘাট এলাকাতেই থাকতে বলা হলো। ফলে পূর্ব পরিকল্পান অনুযায়ী শহরের যুদ্ধে আমার সঙ্গে যোগ দেয়া তার পক্ষে আর সম্ভব হলো না।

 কক্সবাজারে ইপিআর কোম্পানীর কমাণ্ডার ছিলেন সুবেদার মফিজ। তিনি দুটি ইপিআর কোম্পানী নিয়ে আমার সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য কক্সবাজার ত্যাগ করেছিলেন। তাকেও কালুরঘাট এলাকায় থামিয়ে সেখানেই আত্মরক্ষামূলক অবস্থান গ্রহণ করতে বলা হয়। তিনি পরে আমাকে বললেন। আপনার সাথে যোগ দিতে পারিনি এটা আমার ত্রুটি ছিলো না। মেজর জিয়া আমাকে কালুরঘাটে থামিয়ে দিয়েচিলেন। আমি তাকে আপনার নির্দেশের কথা জানালে তিনি আমাকে জানান শহরে কেউ নেই। অবশ্য পরে দেখা গেলো আপনি তখনো শহরে যুদ্ধ করে চলেছেন।

 আমরা তখনো শহর ছাড়িনি। বিভিন্ন জায়গায় প্রচণ্ড লড়াই হচ্ছিলো। কিন্তু ঘটনাবলী শহরের পরিস্থিতিকে যেদিকে নিয়ে যাচ্ছিলো তা মোটেই আমার জন্য অনুকুল ছিলো না।

 কক্সবাজার এবং কাপ্তাই থেকে যে সৈন্যরা আসছিলো কালুরঘাট ব্রিজের কাছে তাদের থামিয়ে দেয়া হচ্ছিলো। কুমিরায় প্রধান সড়ক বরাবর প্রচণ্ড সংঘর্ষের দরুন রামগড়ের সৈন্যরা আসতে পারছিলো না। শহরে