পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১০৪

 অপরদিকে সামরিক বাহিনীর মধ্যে আওয়ামী লীগের যুবকদের প্রতি তেমন অবিশ্বাস। এর মধ্যে মুজিব বাহিনী সৃষ্টির ফলে এই অবিশ্বাস আরো বৃদ্ধি পায়। একজন সংসদ সদস্য থাকা সত্ত্বেও ওসমানী মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বহু সামরিক অফিসারের মধ্যে তাকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। তাদের বক্তব্য ছিল সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তির অধিনায়ক হওয়া উচিত নয়।

 জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ প্রমুখ ওসমানী সম্পর্কে এ ধরনের উদাসীন উক্তি করেছেন। সামরিক বাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা তখন থেকেই শুরু হয়। শফিউল্লাহ, জিয়া ও খালেদ এই তিন জনের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল বলে আমার ধারণা। শফিউল্লাহ ও খালেদ দু’জনেই যুদ্ধে বীরত্বের পরিচয় দেন। এরা চিরকাল বীর হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। জিয়ার তেমন কোন বীরত্বের নজীর নেই। তবে তাঁর মধ্যে ক্ষমতার অস্পষ্ট প্রস্তুতি তখন থেকেই লক্ষ্য করা গেছে। নূরুল ইসলাম শিশু প্রধানমন্ত্রীর মিলিটারী সেক্রেটারী হিসেবে কাজ করেন। প্রধানমন্ত্রী বলতেন, “সামরিক বাহিনীর সকল অফিসারের সহযোগিতা ও সম্মান আমাদের অর্জন করতে হবে। তবে আমাদের প্রতি তাদের আস্থার অভাব স্পষ্টতই দেখা যায়। শিশু তাদের পক্ষ হয়ে আমাদের কাছে আছেন ও থাকবেন। আমাদের কতটুকু কাজে লাগবে জানি না। তবে তার মাধ্যমে সামরিক অফিসারদের আস্থা ও সম্মান অর্জন করার চেষ্টা করা উচিত। ওদের এটাও বুঝানো দরকার যে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া স্বাধীনতা যুদ্ধ অচল এবং নতুন দেশ গড়াও অসম্ভব। তাই দেশ প্রেমের তাগিদে যারা অস্ত্র ধরেছেন, একই কারণে রাজনৈতিক নেতৃত্বের পেছনে ওদের কাতারবন্দী হওয়াও উচিত।”

 সামরিক বাহিনীর সাথে মুজিব বাহিনীর, মুজিব বাহিনীর সাথে অনিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ও রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের খুটিনাটি বিরোধ দেখা দেয়। এসব বিষয় আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটির বৈঠকেও আলোচনা হয়। তাজউদ্দিন ভাই এ বিষয়ে সুন্দর ভাবে বিশ্লেষণ করে সঠিক মূল্যায়নের নির্দেশ দেন। তাঁর বক্তব্য ছিল কে বা কারা পাকিস্তানী ভাবধারায় অগণতান্ত্রিক ও স্বেচ্ছাচারী গণবিরোধী মনোভাব প্রভাবাম্বিত বা কে তা নন, এর বিচার শুধু ভবিষ্যতেই সম্ভব।

 নয় মাসের সংক্ষিপ্ত সময়ে তাজউদ্দিন ভাই-এর সেই আবেদন কতটুকু সফল হয়েছিল তা ভবিষ্যৎ ইতিহাসই বলবে। প্রত্যেক সেক্টর কমাণ্ডারের সাথে যোগাযোগ করার জন্য একজন করে লিয়াজোঁ অফিসার নিয়োগ করা হয়। বেশীর ভাগ লিয়াজোঁ অফিসার ছিলেন সংসদ সদস্য। সামরিক বাহিনীর সাথে সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ার লক্ষ্য এই পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল।

 পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস থেকে যে সব অফিসার যোগ দেন, এদের মধ্যে উচ্চাভিলাষী লোকের অভাব ছিল না। আবার এদের মধ্যে বেশীর ভাগ অফিসারই অসীম সাহসিকতা, ত্যাগ ও কর্মস্পৃহার পরিচয় দেন।

 মাগুরা ও মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক কামালউদ্দিন ও তওফিক এলাহীর অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। একজন ছেলেদের সাথে বন্দুক কাঁধে নিয়ে যুদ্ধে যেতেন, যিনি পরে ঢাকা জেলার জজ হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ এমন একটি ব্যাপক ও সম্মানিত আন্দোলন ছিল। এখানে অনেক লোকই তাদের পোষাকী, পদবী ও মনোভাব বর্জন করতে পেরেছিলেন। কিন্তু পাক সিভিল সার্ভিসের অনেকের মধ্যে পদবী মেজাজের রেশ ছিল। ফলে রাজনৈতিক মহলে এই নিয়ে কিছুটা ক্ষোভ দেখা দেয়। এই পদবীজনিত মনোভাবের কারণে পরবর্তীকালে বাংলাদেশে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল। তবে এদের সংখ্যা খুব বেশী ছিল না।

 এসব পদবী মনোভাবাপন্ন অফিসারদের আমলাতান্ত্রিক মনোভাব, ফাইলের খেলা, কলম দিয়ে পিষে নোট লিখা, লাল ফিতাতে বাঁধা এমন এক পর্যায়ে এলো যে পুরো ৪/৫ তলা বাড়ী প্রবাসী সরকারের অফিসে পরিণত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের ব্যাপকতায় এদের মিশিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। ফলে এরা একটি ভিন্ন মনোভাব ও ভিন্ন স্রোত হয়ে দেশে ফিরে আসে।