পাতা:বাংলাভাষা পরিচয়-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাভাষা-পরিচয়

নে, আশা করি বলে না। ‘পুরাইতে’ বলতে ‘পুরুতে’ কিংবা ‘ঠকাইতে’ বলতে ‘ঠকুতে’ শুনি নি। আমার নিশ্চিত বোধ হয় ‘কান জুড়ুল’ কেউ বলে না, অথচ ঘুমাইল’ ও ‘জুড়াইল’ একই ছাঁদের কথা। ‘আমাকে’ দিয়ে তার ঘোড়াটা কিনাইল বাক্যটাকে চলতি ভাষায় যদি বলে আমাকে দিয়ে তার ঘোড়াটা কিনুল’, আমার বোধ হয় সেটা বেআড়া শোনাবে। এই শোনাবে’ শব্দটা ‘শুনুবে’ হয়ে উঠতে বোধ হয় এখনো দেরি আছে। আমরা এক কালে যে-সব উচ্চারণে অভ্যস্ত ছিলম এখন তার অন্যথা দেখি, যেমন: পেতোল (পিতোল), ভেতোর (ভিতোর), তেতো (তিতো), সোন্দোর (সন্দোর), ডাল দে (দিয়ে) মেখে খাওয়া, তার বে (বিয়ে) হয়ে গেল।

 উকারের ধ্বনি তার পরবর্তী অক্ষরেও প্রতিধ্বনি হতে পারে এতে আশ্চর্যের কথা নেই, যেমন: মণ্ডু কুণ্ডু শুদ্দুর রুদ্দুর পুত্তুর মুগুর। তবু ‘কুণ্ডল’ ঠিক আছে, কিন্তু ‘কুণ্ডুলি’তে লাগল উকার। ‘সুন্দর’ ‘সুন্দরী’তে কোনো উৎপাত ঘটে নি। অথচ 'গণনা’ শব্দে অনাহত উকার এসে বানিয়ে দিলে ‘গুনে’। ‘শয়ন থেকে হল ‘শুয়ে’, ‘বয়ন’ থেকে ‘বুনে’, ‘চয়ন’ থেকে ‘চুনে’।

 বাংলা অকারের প্রতি বাংলা ভাষার অনাদরের কথা পূর্বেই বলেছি। ইকার-উকারের পূর্বে তার স্বরপে লোপ হয়ে ও হয়। ঐ নিরীহ সবরের প্রতি একারের উপদ্রবও কম নয়। উচ্চারণে তার একটা অকার-তাড়ানো ঝোঁক আছে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় সাধারণ লোকের মুখের উচ্চারণে। বাল্যকালে প্রলয়-ব্যাপারকে ‘পেল্লায়' ব্যাপার বলতে শুনেছি মেয়েদের মুখে। সমাজের বিশেষ স্তরে আজও এর চলন আছে, এবং আছে: পেল্লাদ (প্রহ্লাদ), পেরনাম (প্রণাম), পেরথম (প্রথম), পেরধান (প্রধান), পেরজা (প্রজা), পেসোন্নো (প্রসন্ন), পেসাদ অথবা পেরসাদ (প্রসাদ)। ‘প্রত্যাশা’ ও ‘প্রত্যয়’ শব্দের অপভ্রংশে প্রথম বণে হস্তক্ষেপ না ক’রে দ্বিতীয় বণে বিনা কৈফিয়তে একার নিয়েছে বাসা, হয়েছে ‘পিত্তেস’.

৬৮