পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

উপযোগী অনন্য উচ্চারণ সৃষ্টির তাগিদে নিজেই ঐ মান্যতার বিরুদ্ধাচারণ করে। এই প্রক্রিয়াটিকে আপাতদৃষ্টিতে খুব জটিল বলে মনে হলেও তা ঘটে স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সারা জীবন ধরে যে-প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে, তারই নিরিখে ভাষা ব্যবহারকারী সত্তাকেও চিনে নিই। অর্থাৎ ভাষা ব্যবহারের পদ্ধতিতেই সত্তার অভিজ্ঞান নির্ধারিত হয়। অভ্যস্ত বাচনের বাঁধাধরা প্রকরণে যারা স্বেচ্ছাবন্দী, তাদের অস্তিত্বও রুদ্ধ। প্রতিবেদনের মধ্যে অস্তিত্বের ঈঙ্গিত মুক্তি সে-ই সঞ্চারিত করতে পারে যার জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে স্বতন্ত্র উচ্চারণ নির্মাণের দক্ষতা প্রমাণিত। বলা বাহুল্য, এ এক বিশেষ ধরনের নির্মাণ: কেননা তাতে পূনর্মূল্যায়নের প্রেরণাই মূল চালিকাশক্তি। বাচন মানেই সংযোগের প্রয়াস নিশ্চয়, তবে সেই সংযোগ মূল্যনিরপেক্ষ হতে পারে না কখনো। যতক্ষণ মূল্যায়নের আকাঙ্ক্ষা উচ্চারণের সঞ্চালক না হচ্ছে অন্তত ততক্ষণ অভিব্যক্তি তাৎপর্যবহ ও লক্ষ্যাভিমুখী হবে না। ভাষার নিরপেক্ষতা একটি কথার কথা মাত্র; চিহ্নায়ক ও অন্তঃসারের নিরিখে তা অসম্ভব। ভাষা কখনো উদ্ভাসিত করে আবার কখনো আবৃতও করে। উচ্চারণে অন্তর্বর্তী অন্ধবিন্দুগুলির অস্তিত্ব সম্পর্কে সমস্ত প্রতিবেদক হয়তো অবহিত নন; কিন্তু তাতে পরাবাচনের সম্ভাবনা নিরাকৃত হয়। না। সত্তা ও জগতের মধ্যবর্তী দৃশ্য ও অদৃশ্য পরিসরের চলমান দ্বিরালাপকে অনুভব করতে পারি একমাত্র বাচন ও পরাবাচনের আততিতে। বাখতিন-চিন্তাবৃত্তের কাছে আমরা ঋণী এইজন্যে যে, এইসব সূক্ষ্মগভীর ও সুদূরপ্রসারী উপলব্ধিকে আজীবন নিরন্তর অনুশীলন করার প্রেরণা তার কাছে পাচ্ছি।

 বাখতিনের অন্যতম প্রসিদ্ধ মহাবাক্য হলো: ‘Language enters life through concrete utterances’। জীবনে অর্জিত অভিজ্ঞতার মধ্যে নিহিত আলো-ছায়ার বিন্যাসে যখন প্রতিবেদন গড়ে ওঠে, তাতে বিধি-বিন্যাসের যান্ত্রিকতা ব্যক্ত হয় না কেবল। কারণ, প্রতিবেদন শুধুই প্রণালীবদ্ধ বাচনের ফসল নয়; তা মূলত ঘটনা। অস্তিত্বের বিভিন্ন মাত্রা ছুঁয়ে আসে যে-দ্বিরালাপের ক্রিয়া, প্রতিবেদন তারই প্রতিনিধি। এইজন্যে তা সর্বদা সম্ভাব্য এক উদ্‌ভাসন; একদিকে বাচক ও অন্যদিকে গ্রহীতার উপস্থিতিতে তার অবস্থান নিত্য জায়মান। যতক্ষণ উচ্চারণ সজীব, ততক্ষণই তার আয়ুষ্কাল। ভাষার সংযোগ-ক্ষমতাও এই বিষয়টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। যেহেতু গ্রহীতা বাচকের দ্বিবাচনিক অংশীদার, ভাষা-বয়ান প্রতিবেদনে অপরতার বোধ অন্তঃশায়ী। তাই উচ্চারণ মানে সম্বোধ্যমানতার প্রত্যয়। সম্বোধক ও সম্বোধিতের সম্পর্ক অনবরত রূপান্তরিত হচ্ছে বলেই ভাষায় বিনির্মাণের প্রবণতা স্বতঃসিদ্ধ। বাখতিন/ভোলোশিনোভ রচিত Marxism and the Philosophy of Language বইটির নিবিড় পাঠ আবশ্যিক। তবে বাখতিন-ভাবনা কোনো-একটি বইয়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ নয় বলে এবং ভাবকল্পগুলি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ঊর্ণাতন্তুর মতো অন্যোন্যসম্পৃক্ত বলে তার অন্য সব বয়ান সম্পর্কেও মনোযোগী হতে হয়।

 বাখতিনের কোনো বক্তব্যই আকস্মিকভাবে উদ্ভূত নয় বলে প্রাগুক্ত সম্বোধ্যমানতা এবং দ্বিবাচনিক উচ্চারণের তাৎপর্যকে সর্বদা বুঝে নিতে হয় নান্দনিক সংযোগের সামগ্রিকতায়। যেহেতু তার মতে প্রসঙ্গ চায় প্রেক্ষিতের সমর্থন, বাচনিক উপাদানের গুরুত্ব নির্ণয় করতে হলে উচ্চারণের বাচনাতিরিক্ত পটভূমির কথাও পরীক্ষা করে দেখতে হয়। উচ্চারণ যুগপৎ ব্যক্তিগত ও সামাজিক প্রক্রিয়া; তবে এই দুইয়ের আনুপাতিক গুরুত্ব নির্ণয় করতে হলে

৪৬