পাতা:বাখতিন - তপোধীর ভট্টাচার্য.pdf/৬৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

ধারণার সমর্থন খোঁজার জন্যে গবেষকেরা এই দুটি প্রতিবেদনকেই ব্যবহার করতে পারেন। ফলে বাখতিনের চিন্তাজীবনের সূচনাপর্ব তাঁর পরিণত পর্বের সঙ্গে কীভাবে ও কতখানি দ্বিবাচনিকতায় সম্পৃক্ত—তা দৃষ্টির আড়ালে চলে যেতে পারে। এইজন্যে সবচেয়ে ভাল উপায় হচ্ছে নিয়ত প্রসারণশীল মুক্ত বয়ানের আপাত-স্বাতন্ত্র্যে প্রাগুক্ত দুটি প্রতিবেদনকে গ্রহণ করা। এই নিবন্ধ-প্রয়াসীও মূলত এই পদ্ধতি অনুসরণ করছে।

 আসলে বাখতিনের চিন্তাবিশ্বে উন্মুক্ততাই কেন্দ্রীয় বৈশিষ্ট্য। তাঁর সমস্ত প্রধান চিন্তাবীজের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে মুক্ত পরিসরের প্রতীতি যা নিয়ত সঞ্চরমান ও চূড়ান্তবিন্দু বিহীন। তাই তাঁর চিন্তাবিশ্বে পর্যটন অনন্য এক অভিজ্ঞতা। যে-কোনো বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করি না কেন, শেষ পর্যন্ত ফিরে আসি সেই বিন্দুতেই। তাই এতে কোনো যাওয়া নেই, আসাও নেই। আছে এমন এক অনন্ত বিস্তার যার নিরিখে সত্তা নিজেই নিজেকে নির্মাণ করে অনবরত। অফুরান এই অধ্যবসায়ে কল্পিত এক শীর্ষবিন্দু থাকে হয়তো, কিন্তু তা কেবল কোনো নির্দিষ্ট মুহূর্তের জন্যে। কেননা সমগ্রতা বা পূর্ণতার ধারণা কখনো অর্জন করা যায় না। তাই মুহূর্তেই অবসান হয় কাঙ্ক্ষিত সেই পরমতার। বলা ভালো, পরমতাও এক নির্মিতি এবং সেইজন্যে দ্বিরালাপের অন্তহীন প্রক্রিয়ায় সেই নির্মিতিকেও নিরাকৃত হতে হয় কখনো-না-কখনো। স্বয়ংসম্পূর্ণ কোনো একীভূত অভিজ্ঞান সত্তা কখনো অর্জন করতে পারে না। আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার জগতে কিংবা দ্বান্দ্বিক চিন্তার অতিশৃঙ্খলিত যৌক্তিক বিন্যাসে সম্পূর্ণতা ও চূড়ান্ততা পুরোপুরি অলীক। অতএব সম্ভাব্য সম্বোধিত গ্রাহক অস্তিত্বের দিকে অনবরত বয়ে যায় জীবন, নতুন নতুন কৃত্য ও উদ্যম নির্মাণের মধ্যে প্রমাণিত হয় জীবনের অস্তিত্ব। জীবজগৎ বিকশিত হয় তারই সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত পরিবেশে যার বিচিত্র স্থিতির উদ্দেশে অনবরত প্রত্যুত্তর রচনার ক্ষমতাতেই পরীক্ষিত ও নির্ণীত হয় জীবনের শক্তি, অস্তিত্বের তাৎপর্য।

 প্রত্যুত্তর-যোগ্যতা ও উদ্যমের দর্শন আপাতভাবে দুটি আলাদা খাত ধরে একই মোহনার দিকে প্রবাহিত হয়েছে। প্রতিবেদনের মধ্যে যেভাবে উপস্থাপিত বা পুনরুত্থাপিত হয় জগৎ এবং বিভিন্ন ঘটনা ও উদ্যমের অভিজ্ঞতায় যেভাবে ব্যক্ত হয় জীবন—তাদের আন্তঃসম্পর্ক নিয়ে বহুমাত্রিক ভাবনার সূত্রপাত করেছেন বাখতিন। এসেছে রচনা-প্রক্রিয়া, রচয়িতা, দায়বোধ, নন্দনের নৈতিকতা, সত্তা-বহির্ভূত অথচ সত্তায় সম্পৃক্ত বাহিরের প্রসঙ্গ। আর জেনেছি, কীভাবে কোনো প্রক্রিয়ায় যোগ দিয়েই নির্মাণ করতে হয় চিন্তাবিশ্বের স্থাপত্য। অস্তিত্বের বিপুল মহাপরিসরে তবু হুবহু পুনরাবৃত্ত হয় না কোনো কিছু; অনন্যতা পরাভূত হয় না কিছুতেই। সত্তা ও ভাষা, জগৎ ও মন, যথাপ্রাপ্ত ও সৃষ্টির মধ্যে চলমান দ্বিবাচনিকতার কেন্দ্রে পৌঁছানোর যাত্রা এভাবেই প্রাথমিক যুগল প্রতিবেদনে শুরু হলো। একদিকে বস্তুবিশ্ব এবং অন্যদিকে চিহ্নবিশ্বের গ্রন্থনা অর্থাৎ অভিজ্ঞতার ক্রম ও উপস্থাপিত অভিজ্ঞতার নির্যাস-ক্রম: এই দুইয়ের অনস্বীকার্য ব্যবধান কীভাবে পেরিয়ে গেলেন বাখতিন? এদের পার্থক্যপ্রতীতিকে মান্যতা দিয়েও কীভাবে এবং কেন সংযোগের সেতু গড়ে তোলার কথা ভাবতে পারলেন তিনি? এইসব আনুষঙ্গিক জিজ্ঞাসা এবং তাদের মীমাংসাপ্রয়াস সম্পর্কে আমাদের অবহিত করে তোলে এই যুগল প্রতিবেদন যাতে আমরা নিজেরা ক্রমশ প্রত্যুত্তরযোগ্যতা অর্জন করতে পারি। পৃথিবী-বিখ্যাত বাখতিন-বিশেষজ্ঞ মাইকেল হলকুই Toward a Philosophy of the

৬০