পাতা:বিদ্যাসাগর জননী ভগবতী দেবী.pdf/৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
৭৪
জননী ভগবতী দেবী

আগমন করিয়া হিন্দু, প্রথানুসারে দণ্ডবৎ হইয়া, বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জননীকে প্রণাম করিলেন। তিনি হিন্দু, প্রথানুযায়ী যোগাসনে বসিয়া আহারাদি সমাপন করিয়াছিলেন। ভগবতী দেবী সাহেবের ভোজন সময়ে উপস্থিত থাকিয়া তাঁহাকে ভোজন করাইয়াছিলেন। সাহেব তাঁহার সদ্ব্যবহারে আশ্চর্য্যান্বিত হইয়াছিলেন। অতি বৃদ্ধা হিন্দু স্ত্রীলোক, সাহেবের ভোজনের সময় চেয়ারে উপবিষ্টা হইয়া কথাবার্ত্তা কহিতে প্রবৃত্ত হইলেন দেখিয়া উপস্থিত সকলে ও সাহেব পরম সন্তুষ্ট হইয়াছিলেন। ভগবতী দেবী প্রবীণ হিন্দুু, স্ত্রীলোক, তথাপি তাঁহার স্বভাব অতি উদার, মন অতিশয় উন্নত, এবং মনে কিছুমাত্র কুসংস্কার নাই। কি ধনশালী, কি দরিদ্র, কি বিদ্বান, কি মূর্খ, কি উচ্চজাতীয়, কি নীচজাতীয়, কি পুরুষ, কি স্ত্রী, কি হিন্দুধর্ম্মবলম্বী, কি অন্য ধর্মাবলম্বী সকলেরই প্রতি সমদৃষ্টি; ইহা জানিতে পারিয়া সকলেই চমৎকৃত হইলেন এবং পরম সন্তোষ লাভ করিলেন।

 ভোজনান্তে হারিসন্ সাহেব ভগবতী দেবীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনার কত ধন আছে?” ভগবতী দেবী স্মিতমুখে উত্তর করিলেন,—“বাবা, চারি ঘড়া ধন আছে।'’ সাহেব বললেন-“আপনার এত ধন আছে? ভগবতী তখন সহাস্য বদনে জ্যেষ্ঠ পুত্র বিদ্যাসাগর মহাশয় ও অপর তিনটি পুত্রের প্রতি অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া বলিলেন— “এই আমার চারি ঘড়া ধন।” সাহেব বিস্মিত হইয়া বিদ্যাসাগর ও উপস্থিত জনসমূহকে বলিলেন,—“ইনি দ্বিতীয় রোমীয় রমণী কর্ণিলিয়া।

 তৎপরে ভগবতী দেবী হারিসন্ সাহেবকে বলিলেন, “দেখ বাবা, তুমি অতি দায়িত্বপূর্ণ কার্য্যের ভার লইয়া এই জেলায় আসিয়াছ। দেখিও যেন গরীব দুঃখীর অনিষ্ট না হয়। তুমি এরূপ ভাবে কার্য্য করিবে যে, তুমি এ জেলা পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেও যেন লোকে তোমার জন্য হায় হায় করে।” সাহেব ভগবতীর কথা শুনিয়া অত্যন্ত সন্তুষ্ট হইলেন। এবং বিদ্যাসাগর মহাশয়কে বলিলেন, “এমন মা না হইলে, আপনি ঐরূপ হইতে পারিতেন না। মাতার গুণেই আপনি স্বভাবত উন্নতমনা হইয়াছেন।”

 তৎপরে সাহেব বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বসতবাটীর চতুর্দ্দিক পরিভ্রমণ করিয়া দেখিলেন। এবং সকল স্থানই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন দেখিয়া বলিলেন, “আমি অনেক বাটীতে পদার্পণ করিয়াছি, কিন্তু এরূপ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গৃৃহ আমার কুত্রাপি নয়নগোচর হয় নাই। জানিলাম, আপনার মাতৃদেবী অশেষ গুণান্বিত। ইহার তুলনা নাই।”

 হারিসন সাহেব এক সময়ে কোন কার্য্যোপলক্ষে বিদ্যাসাগর মহাশয়কে পত্র লিখেন। তাহাতে তিনি একস্থানে উল্লেখ করিয়াছিলেন, “আপনার জননীর উপদেশানুযায়ী আমি কর্ত্তব্য সম্পাদন করিতে সতত যত্নবান আছি। তাঁহাকে