পাতা:বিভূতি রচনাবলী (অষ্টম খণ্ড).djvu/৩৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৬২ বিভূতি-রচনাবলী তাতে পায়ে পড়ে বাহাঙ্কুরি কেনবার কি এমন আছে। —বেশ, মানলুম সুমন্ত পয়লাকড়ি আমার, আমার কলকাতা শহরে চোদখান বাড়ী, তার ,মাসিক আট শ টাকা ভাডা। এখন আপাতত দয়া করে আমার জন্তে একথানা লালাবাই সাবান এনে দাও দিকি । অভয় তাহার স্ত্রীকে প্রবোধ দিল, পাগল নাকি ! ফেনা করে সাডে চার আনা পয়সা জলে দেবে ? না, ও বিলালিত আমাদের এখানে চলবে না। সেই স্ত্রীর মৃত্যুশোকে মুহমান হইয়া অভয় ছয় দিন ছয় রাত্রি আহার নিদ্রা ত্যাগ কবিল। বন্ধুরা সকলে বিপদ গণিল। এই নিদারুণ শোকাবেগের হীত হইতে কি করিয়া তাহাকে রক্ষা করিবে ! সকলে সাত্বনা দিবার চেষ্টা করিল, প্রিয়জনের মৃত্যুজনিত বিরহে কাতর মানুষটিকে সেই বহুশ্রুত দার্শনিক মতবাদ দিয়া বুঝাইবার হাস্যকর প্রচেষ্টা । সেই— মানুষ মরণশীল, মৃতব্যক্তির জন্য শোকপ্রকাশ করা নাকি দুৰ্ব্বলতার লক্ষণ, রাজর্ষি জনকের নির্লিপ্ততার দৃষ্টান্ত, সরিষা আনিবার জন্ত বুদ্ধের উপদেশ, যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধৰ্ম্মরাজ বকের প্রশ্ন—ইত্যাদি ইত্যাদি নানাবিধ কথায় তাহকে ভুলাইতে চেষ্টা করিল। অভয় তবুও প্রথমট ভোলে নাই । ছয় দিন ছয় রাত্রির পর আজ সবে সে পত্নীশোক কিঞ্চিৎ বিশ্বত হইয়া সামান্ত ঘুমাইয়াছে এহেন সময়ে সেই বিকট শব হইল। অভয় একদৃষ্টি বকুলের শূন্ত শয্যার পানে চাহিয়া রহিল। বুকখানার ভিতর হু হু করিয়া উঠিল। ডাকাত নয়, তবে চোব হইলে হইতে পারে। কিন্তু চোর বলিয়াও তো বোধ হইতেছে না। তবে এ কিসের শব্দ? অভয় দরজার একটি গৰ্ত্ত দিয়া দেখিল ফুটফুটে জ্যোৎস্ন', আকাশের মাঝে উজ্জ্বল চাদ সাদা, দীপ্তিময়ী তারকারাশি। অভয় বিছানায় আসিয়া ঝুপ করিয়া বসিয়া পডিল । কিসের এ শব্দ ? আচমকা মনে পডিল হয়তো তাহার মৃত স্ত্রীব কীৰ্ত্তি, হয়তো বেচারা এ ভুগতের মায়া-পাশ ছিন্ন করিয়াও স্বামীকে ভুলিতে পারে নাই । তাই কি নিঃশব রাত্রে স্বামীর সহিত দেখা করিতে আসিয়াছে ? তৎক্ষণাৎ ভয়ে তাহীর গা ডোল হইয়া শিহরিয়া উঠিল। না, স্ত্রীর এই উৎকট ভালবাসা সে কিছুতেই গ্রহণ করিতে পরিবে না। ক্রমে ক্রমে তাহার সমস্ত চেতনা লোপ পাইতে লাগিল। বকুলের শূন্ত শয্যার পানে চাহিবার সাহস আর তাহার রহিল না। সমস্ত শোক-দুঃখ-বেদন ভয়ে ও ভাবনায় রূপান্তরিত হইল। সে কিংকৰ্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া শয্যার উপর অবশ ভাবে বসিয়া রহিল। কি সে করিবে ? চিৎকার করিবে, না জ্ঞান হারাইয়া ফেলিবে ? ভাবিয়া সে কুল-কিনারা পাইল না। সে ছেলেবেলায় কত ভৌতিক কাহিনী পড়িয়াছে আজ কেমন যেন সেই সব নানা ভৌতিক ব্যাপার জীবন্ত হইয়া উঠিল। সে বন্ধ জানালা-দরজার পানে সচকিত চিত্তে একদৃষ্টি চাহিয়া রহিল। কে জানে কোন মুহূর্তে দম্বক বাতাসে জানালী-দরজাগুলি হুড়মুড় করিয়া খুলিয়া যায়।