পাতা:বিভূতি রচনাবলী (চতুর্থ খণ্ড).djvu/৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

দৃষ্টি-প্রদীপ \ס(: মালা দু'তিনটে শিয়রের কাছে পাত, তাতে কাশ খুধু ফেলেচে রুগী। আমার গা কেমন বমি-বমি করতে লাগল। আর কি কনকনে ঠাও ! খেজুরের পাতার বীপে কি মাঘ মাসের শীত আটকায় ? দত্তদের কাটালবাগান থেকে শুকনে কাটালপাতা নিয়ে এসে দাদা আগুন জাললে। একটু পরে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়লাম। কত রাত্রে জানি না, আমার মনে হ’ল হীরুজ্যাঠা আমার সামনে দাড়িয়ে আছে। হীরুজ্যাঠা আর কাশচে না, তার রোগ যেন সেরে গিয়েছে! আমার দিকে চেয়ে হেসে বললে, “জিতু, আমি বঁাশবেড়ে যাচ্ছি গঙ্গা নাইতে । আমায় বড় কষ্ট দিয়েছে হরিবল্লভ ( আমার জ্যাঠামশাই ), আমি বলে যাচ্ছি, নিৰ্ব্বংশ হবে, নিৰ্ব্বংশ হবে । তোমরা বাড়ি গিয়ে শোও গে যাও।” আমার গা শিউরে উঠলো—এত স্পষ্ট কথাগুলো কানে গেল, এত স্পষ্ট হীরুজ্যাঠাকে দেখলাম যে বুঝে উঠতে পারলাম না প্রত্যক্ষ দেখছি, না স্বপ্ন দেখছি। ঘুম কিন্তু ভেঙে গিয়েছিল, দাদা দেখি তখনও কুঁকুড়ি হয়ে শীতে ঘুমুচ্ছে, কাটালপাতার আগুন নিভে জল হয়ে গিয়েছে, হীরুজ্যাঠাও ঘুমুচ্ছে মনে হ'ল। বাইরে দেখি ভোর হয়ে গিয়েছে। দাদাকে উঠিয়ে নলিনীদিদির বাবা রামগতি মুখুজ্জেকে ডাকিয়ে আনলাম। তিনি এসে দেখেই বললেন, “ও তো শেষ হয়ে গিয়েছে । কতক্ষণ হ’ল ? তোরা কি রাত্রে ছিলি নাকি এখানে ?" হীরুঠাকুরের মৃত্যুতে চোখের জল এক দাদা ছাড়া বোধ হয় আর কেউ ফেলে নি । অনেক দিন পরে শুনেছিলাম, হীরুঠাকুর পৈতৃক কি জমিজমা ও দুখান আম-কঁাটালের বাগান বন্ধক রেখে জ্যাঠামশায়ের কাছে কিছু টাকা ধার করে এবং শেষ পর্য্যস্ত হীরুঠাকুর সে টাকা শোধ না করার দরুন জ্যাঠামশায় নালিশ ক’রে নিলামে সব বন্ধকী বিষয় নিজেই কিনে রাখেন। এর পর হীরুঠাকুর আপসে কিছু টাকা দিয়ে সম্পত্তিটা ফিরিয়ে নিতে চেয়েছিল— জ্যাঠামশায় রাজী হন নি। কেবল বলেছিলেন ব্রাহ্মণের ভিটে আমি চাইনে—ওটা তোমায় ফিরিয়ে দিলাম। হীরু তা নেয় নি, বলেছিল, সব যে পথে গিয়েছে, ও ভিটেও সে পথে যাক । এর কিছুকাল পরেই তার মাথা খারাপ হয়ে যায়। বিষয় বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে জ্যাঠামশায়ের দান-ধ্যান-ধৰ্ম্মানুষ্ঠানও বেড়ে চলেছিল। প্রতি পূর্ণিমায় তাদের ঘরে সত্যনারায়ণের পূজা হয় যে তা নয় শুধু—একটি গরিব ছাত্রকে জ্যাঠাইম বছরে একটি টাকা দিতেন বই কেনবার জন্তে । শ্রাবণ মাসে তাদের আবাদ থেকে নৌকা আসে নানা জিনিসপত্র বোঝাই হয়ে—বছরের ধান, জালাভরা কইমাছ, বাজরাভরা হাসের ডিম, তিল, আকের গুড় আরও অনেক জিনিস। প্রতি বছরই সেই নৌকায় দুটি একটি হরিণ আসে। ধনধান্তপূর্ণ ডিঙ নিরাপদে দেশে পোঁচেছে এবং তার জিনিসপত্র নিৰ্ব্বিয়ে ভাড়ার ঘরে উঠল এই আনন্দে তারা প্রতিবার শ্রাবণ মাসে পাঠা বলি দিয়ে মনসাপূজা করতেন ও গ্রামের ব্রাহ্মণ খাওয়াতেন। বৈশাখ মাসে গৃহদেবতা গোপীনাথ জীউর পূজোর পালা পড়ল ওঁদের। জ্যাঠামশায় গরদের জোড় পরে লোকজন ও ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়ে কাসরঘণ্টা, ঢাকঢোল বাজিয়ে ঠাকুর নিয়ে এলেন ও পাড়ার জ্ঞাতিদের বাড়ি থেকে—জ্যাঠাইমা খুড়ীমারা বাড়ির দোরে দাড়িয়ে ছিলেন—প্রকাও পেতলের সিংহাসনে বসানো শালগ্রাল বয়ে আনছিলেন জ্যাঠামশায় নিজে—তিনি বাড়ি ঢুকবার সময়ে জ্যাঠাইমা জলের ঝার দিতে দিতে ঠাকুর অভ্যর্থনা করে নিয়ে গেলেন। মেয়েরা শাক বাজাতে লাগলেন, উলু দিলেন । আমি, সীতা ও দাদা আমাদের ঘরের বারাঙ্গা থেকে দেখছিলাম-অত্যন্ত কৌতুহল হলেও কাছে যেতে