পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/১০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

________________

অপেরা সংগীতের মাধ্যমে রূপায়িত হয়, সুতরাং সংগীতের। উপযােগী করিয়াই সেখানে নাটকের ঘটনা ও চরিত্র পরিকল্পিত ও উপস্থাপিত হয়। তবে অপেরা যখন নাটকেরই একটি বিশিষ্ট বিভাগ, তখন লক্ষ্য রাখিতে হইবে যে, অপেরার সংগীত স্বতন্ত্রভাবে গেয় সংগীতের সমপর্যায়ভুক্ত নয়, তাহার প্রধান উদ্দেশ্য নাট্যরসের আবেদন দর্শকচিত্তে জাগাইয়া ভােলা। অপেরা সংগীতপ্রধান হইলেও ইহা রঙ্গমঞ্চে পরিবেশিত হইবার জন্যই লিখিত হয় ; সেই জন্য ইহার রচনা ও মঞ্চে উপস্থাপন বিষয়ে কেবল শ্রাব্যতার দিকে লক্ষ্য রাখিলেই চলে না, দৃশ্যতার দিকেও লক্ষ্য রাখিতে হয়। সেইজন্য দৃশ্যসজ্জা এবং চরিত্রগুলির অঙ্গভঙ্গী ও চোখ-মুখের ক্রিয়াদির প্রতি সুক্ষ্ম দৃষ্টি রাখা দরকার। তবে অপেরার জগৎ সাধারণতঃ বাস্তববন্ধনমুক্ত কল্পনারঞ্জিত জগৎ, সেইজন্য স্বাভাবিকভাবেই অপেরার অভিনয় সাংকেতিক ও ব্যঞ্জনাধর্মী হইয়া পড়ে। | অপেরা নামটি বিদেশী, কিন্তু সংগীতপ্রধান এক বিশেষ শ্রেণীর নাটককে বুঝাইবার জন্য বাংলা সাহিত্যে এই নামটি গৃহীত হইয়াছে। তবে অপেরার আর একটি প্রতিশব্দ বাংলায় ব্যবহৃত হইয়াছে, তাহা হইল গীতাভিনয়। উনবিংশ শতাব্দীতে যাত্রা ও নাটকের মাঝামাঝি এক নৃতন ধরনের নাট্যাভিনয়, প্রচলিত হইল এবং তাহাই গীতাভিনয় নামে আখ্যাত হইল। গীতাভিনয় অনেকাংশে নাটকেরই অনুরূপ, কিন্তু ইহার অভিনয় ছিল যাত্রধর্মী ; অর্থাৎ ইহাতে দৃশ্যপটাদির ব্যবহার হইত না। এই গীতাভিনয়ের উদ্ভব সম্বন্ধে ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দের ১৬ নভেম্বর তারিখের সংবাদ-প্রভাকরে লেখা হইয়াছিল : | “প্ৰচলিত যাত্রাগুলির প্রতি যথার্থ সংগীতপ্রিয় ব্যক্তিগণের নিদারুণ বিতৃষ্ণা জন্মিয়াছে। বঙ্গভূমি করিয়া নাটকের অভিনয় করা অধিক ব্যয়সাধ্য বিবেচনায় কলিকাতার কয়েকজন শিক্ষিত যুবক সামান্যতঃ তৎপ্রণালীতে গীতাভিনয় প্রদর্শন করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। ইহা প্রদেশের পক্ষে শ্লাঘনীয় অনুষ্ঠান সন্দেহ নাই।” | যে সব শখের দল গীতাভিনয়ে খ্যাতিলাভ করিয়াছিল তাহাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য ভবানীপুরের উমেশচন্দ্র মিত্রের দল, কলিকাতায় আরপুলি গলির দল ও শিমুলিয়ার সখের যাত্রা কোম্পানি। শখের দলগুলি সুপরিচিত নাটকগুলিই অতিরিক্ত বহু গান সংযােজন করিয়া গীতাভিনয়ের উপযােগী করিয়া লইত।

১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দের প্রথম দিকে প্রকাশিত অন্নদাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শকুন্তলা’ বাংলা সাহিত্যের প্রথম অপেরা

________________

অপেরা বা গীতাভিনয়। ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে রামনারায়ণের রত্নাবলী অবলম্বনে হরিমােহন কর্মকারের রচিত আর একখানি গীতাভিনয়ও প্রকাশিত হইয়াছিল। ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ১৪ নভেম্বর বৌবাজারের রাজেন্দ্র দত্তের বাড়িতে মধুসূদনের ‘পদ্মাবতী’ নাটকের গীতাভিনয় অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। সংবাদপ্রভাকরের বিবরণে জানা যায় যে, শুধুমাত্র যবনিকা অবলম্বন করিয়া এই অভিনয় হইয়াছিল এবং এই অভিনয়ে তৎকালীন গণ্যমান্য সমাজের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। ইহার পরেও পদ্মাবতীর আরও কয়েকটি অভিনয় হইয়াছিল। ১৮৬৫ খ্ৰীষ্টাব্দে সাবিত্রী-সত্যবান’-এর গীভিনয়ও একাধিক স্থানে অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। পূর্ণচন্দ্র শর্মার ‘শ্রীবৎস রাজার উপাখ্যান নাটক’ (১৮৬৬) -এ প্রাচীন যাত্রার আদর্শ অনেকটা বজায় ছিল। হরিমােহন কর্মকারের ‘জানকীবিলাপ’ (১৮৬৭) গীতাভিনয় রূপে তখন বিশেষ খ্যাতিলাভ করিয়াছিল। জানকীবিলাপ’ সম্পূর্ণরূপে | সংগীতময়, গদ্য ইহাতে মােটেই নাই। এই সময়ে অন্যান্য | যে গীতাভিনয়গুলি প্রকাশিত অথবা অভিনীত হইয়াছিল তাহাদের মধ্যে তিনকড়ি ঘােষালের ‘সাবিত্রী সত্যবান’ ( ১৮৬৭ ), যাদবচন্দ্র বিদ্যারত্নের কীচকবধ-নাটক, | ‘চিত্রাঙ্গদা মিলন’ (১৮৬৯ ), চণ্ডকৌশিক (১৮৬৯), শ্ৰীশচন্দ্র রায়চৌধুরীর ‘লক্ষ্মণ-বর্জন নাটক’ (১৮৭০), হরিশচন্দ্র মিত্রের ‘আগমনী (১৮৭০) প্রভৃতি উল্লেখ যােগ্য। গীতাভিনয় যাত্রা ও নাটকের মাঝামাঝি রূপ হইলেও সংগীতপ্রাধান্তের ফলে ক্রমে গীতাভিনয় ও যাত্রা সমার্থক হইয়া পড়িল। তবে প্রাচীন যাত্রার সহিত গীতাভিনয়যাত্রার পার্থক্য এখানে যে, গীতাভিনয়-যাত্রাতে ঘটনার সংহতি দৃঢ়তর এবং সংঘাত তীব্রতর হইয়া উঠিল। উনবিংশ শতাব্দীতে যাহারা গীতাভিনয়-যাত্রা রচনা করিয়া খ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন তাহাদের মধ্যে ভােলানাথ মুখােপাধ্যায়, কেদারনাথ গঙ্গোপাধ্যায়, মহেশচন্দ্র দাস দে, তিনকড়ি বিশ্বাস প্রভৃতির নাম উল্লেখযােগ্য। গীতাভিনয়-যাত্রাকে যাহারা সর্বাপেক্ষা বেশি জনপ্রিয় করিয়া তুলিয়াছিলেন, তাঁহারা হইলেন ব্রজমােহন রায় ও মতিলাল রায়। ব্রজমােহন প্রথমে পাঁচালির দল চালাইতেন, | সেইজন্য তাহার গীতাভিনয়-যাত্রায় পাঁচালির প্রভাব বেশি

পড়িয়াছিল। সংগীত-রচনা ও কৌতুকরস সৃষ্টিতেও ব্রজ| মােহনের বৈশিষ্ট্য ফুটিয়া উঠিয়াছিল। তাহার যাত্রা| পালাগুলির মধ্যে ‘অভিমন্যুবধ’, ‘রামাভিষেক’, ‘সাবিত্রীসত্যবান’, ‘শতস্কন্ধ রাবণবধ’, ‘দানববিজয়’, ‘কংসবধ’ প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।
৭৫