পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/১০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

________________

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দের কাছাকাছি অবনীন্দ্রনাথের শিল্পীজীবনের যে বিশেষ রকমের পরিবর্তন ঘটে সে সম্বন্ধে রসিকসমাজ আজিও অনবহিত। ১৯২০-১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে অবনীন্দ্রনাথের শিল্প যত বৈচিত্র্যময় হইয়া দেখা দিয়াছিল এমন পূর্বে বা পরে আমরা লক্ষ্য করি না। এই সময়ে স্যর আশুতােষের আন্তরিক চেষ্টায় অবনীন্দ্রনাথ। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাগেশ্বরী অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করেন ( ১৯২১ খ্রী)। | ১৯৩০ খ্রীষ্টাব্দ হইতে অবনীন্দ্রনাথের শিল্প নৃতনরূপে আত্মপ্রকাশ করে। রেখা বর্ণ রূপ- তিনের সমন্বয়ে অবনীন্দ্রনাথ সরল রূপসৃষ্টির প্রয়াস করিয়াছিলেন। অবনীন্দ্রনাথের শেষ জীবনের রচনা যে পরিমাণে মূর্তিধর্মী তাহার সাদৃশ্য পূর্বের রচনাতে আমরা দৈবাৎ পাই। ‘কাটুম কুটুম’ নামে পরিচিত অবনীন্দ্রনাথের শেষ দিকের রচনা সম্পূর্ণ সাহিত্যভাব-বর্জিত আকারনিষ্ঠ ‘বিমূর্ত’ রূপসৃষ্টি। | ১৯৪২ খ্ৰীষ্টাব্দে অবনীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ-প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর আচার্যের পদ গ্রহণ করেন। বিশ্বভারতীর আচার্যরূপে অবনীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে কিছুকাল বাস। করেন। যে মন ও ভাব লইয়া অবনীন্দ্রনাথ কাটুম কুটুম খেলনা গড়িয়াছিলেন সেই মন ও ভাবের প্রকাশ আমরা তাহার শেষের দিকের ছবিতেও পাই। এই সকল ছবি অধিকাংশ ক্ষেত্রে আকারে ছােট এই সময়ে বহু রকমের ‘স্টিল লাইফ’ তিনি করিয়াছিলেন। মৃত্যুর অনধিক কাল পূর্বে অবনীন্দ্রনাথের অঙ্কিত প্রায় সমস্ত ছবি রবীন্দ্রভারতী ক্রয় করেন।

একালে ভারতীয় শিল্পের নবজাগৃতি অবনীন্দ্রনাথের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের ( প্রতিভার ) দ্বারা প্রেরিত বা অনুপ্রাণিত এ কথা সকলেই স্বীকার করিয়াছেন। অপর দিকে অল্প লােকেই অবনীন্দ্রনাথের শিল্প-প্রতিভা নিঃসংকোচে স্বীকার করিতে পারিয়াছেন। অবনীন্দ্র-প্রতিভার গতি এবং অবনীন্দ্রনাথের জনপ্রিয়তা সম্পূর্ণ পৃথক কারণে পৃথক দুইটি ক্ষেত্রে সক্রিয় হইয়াছে। অবনীন্দ্রনাথ শিল্পপ্রেরণাকে অন্তরের অন্তরে স্বীকার করিয়াছেন এবং সাহিত্যগত ভাব ও শিল্পরূপ উভয়ের মধ্যে পার্থক্য তিনি অনুভব করেন। নাই। প্রেরণার শক্তিতে অবনীন্দ্রনাথ চালিত হইয়াছিলেন, এ দেশের বা বিদেশের কোনও পরম্পরা তাহাকে বাঁধিতে পারে নাই। অপর দিকে জনমত তাহাকে কেবলই বধিতে চাহিয়াছিল তারতীয় প্রাচীন পরম্পরার সঙ্গে। অবনীন্দ্রনাথ প্রাচ্য-পাশ্চাত্ত্য নানা পরম্পরা হইতে শিল্পের

________________

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রকরণগত উপায়-উপাদান অনায়াসে সংগ্রহ করিয়াছেন। এই কারণেই তঁাহার শিল্প একান্তভাবে বাংলার অথবা একান্তই ভারতীয় পরম্পরা-বিবর্তন এ কথা বলা চলে না। আন্তর্জাতিক পটভূমিতে অবনীন্দ্রনাথই প্রথম ভারতীয় শিল্পী। শিল্পের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দৃষ্টি উন্মােষিত হইয়াছে সর্বপ্রথম অবনীন্দ্রনাথে। ওমর খৈয়াম, সাহাজাদপুর দৃশ্যাবলী, আরব্য আখ্যানচ্ছবি অথবা কবিকঙ্কণ চণ্ডীর ছবি- এই সব রচনাতে সাহিত্যগত ভাবপ্রকাশের চেষ্টা অপেক্ষা বস্তুনিষ্ঠ রূপসৃষ্টির সাফল্যই বিশেষ দ্রষ্টব্য আর তাহাই ছিল শিল্পের লক্ষ্য। তাঁহার রচিত অজস্র mask বা মুখােশ কল্পনা শিল্পীর আকারনিষ্ঠ রূপনির্মাণের বিশেষ দৃষ্টান্তরূপে গ্রহণ করা সংগত। অপর দিকে তাহার হাতের তৈয়ারি কাটুম কুটুম খেলনা বিমূর্ত শিল্পসৃষ্টির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অবনীন্দ্রনাথের শিল্প প্রতিভার বিবর্তন কি ভাবে সম্ভব হইয়াছে তাহার দৃষ্টান্তস্বরূপ বিশেষ কতকগুলি রচনার উল্লেখ করা গেল। অবনীন্দ্রনাথের যে শিল্পাদর্শ ভারতে জনপ্রিয় হইয়াছে। তাহার মূলে আছে অবনীন্দ্রনাথের দেওয়া শিক্ষা। কাজেই অবনীন্দ্রনাথের শিক্ষানীতি সম্বন্ধে অনুসন্ধান প্রয়ােজন। অবনীন্দ্রনাথ কোনও নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করেন নাই। চিত্রশিল্পের প্রকরণগত কোনও বৈশিষ্ট্য অবনীন্দ্রনাথ তাঁহার অনুবর্তীদের উপর চাপাইয়া দিবার চেষ্টা করেন নাই। অপর দিকে নিজস্ব অঙ্কনরীতির দ্বারাও তরুণ শিল্পীদের প্রভাবান্বিত করার কোনও চেষ্টা অবনীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। সংক্ষেপে অবনীন্দ্রনাথ শিল্পসৃষ্টির উপযুক্ত পরিবেশ গড়িয়া তুলিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। শিল্পপ্রেরণা সম্বন্ধে শিল্পীদের তিনি বারে বারে সচেতন করিয়া তুলিয়াছিলেন। শিল্পশিক্ষার ক্ষেত্রে অবনীন্দ্রনাথের আদর্শ শিল্পীদের মনকে যে ভাবে উদ্বুদ্ধ করিতে পারিয়াছিল তেমন ভাবেই শিল্পীর। শিল্পসৃষ্টির প্রয়াস করিয়াছিলেন। অবনীন্দ্রনাথের প্রভাবে অতি অল্পকালের মধ্যে আধুনিক ভারতীয় শিল্পধারা বৈচিত্র্যময় হইয়া উঠিয়াছিল। অবনীন্দ্রনাথের ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎ প্রভাব অপসৃত হইলে এবং তাহার চিত্ররূপের বাহ্যিক অনুকরণমাত্রে অনেকে প্রবৃত্ত হইলে, অবনীন্দ্রনাথ-প্রবর্তিত শিল্পধারা বৈচিত্র্যহীন সাহিত্যানুকারী, ভাবালু এবং আঙ্গিকের দিক দিয়া দুর্বল হওয়ার কারণে ক্রমেই ক্ষীণ হইয়া আসে। বিনােদবিহারী মুখােপাধ্যায়

চিত্রশিল্পে অবনীন্দ্রনাথের সিদ্ধি এতই মহৎ যে তুলনায় | তাহার সাহিত্যশিল্পের কৃতিত্ব যেন নিষ্প্রভ ; তথাপি
৮২