পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/১০৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

________________

অবনীনাথ ঠাকুর তাহার সাহিত্যকৃতি দুই কারণে শ্রদ্ধেয়। প্রথমতঃ, তাহার চিত্রশিল্প ও সাহিত্যশিল্প উভয়ে মিলিয়া এক অখণ্ড শিল্পীব্যক্তিত্ব রচনা করিয়াছে, তাহার আত্মপ্রকাশের বাহক হিসাবে এক শিল্পকর্ম অপর শিল্পকর্মের সম্পূরক। অবনীন্দ্রনাথের শিল্পপ্রতিভা সম্পূর্ণরূপে বুঝিতে হইলে তাহার চিত্রগুলির সঙ্গে রচনাগুলিও অধ্যয়ন করা একান্ত আবশ্যক। দ্বিতীয়তঃ, তাহার রচনাগুলিতে স্বাধিকারােজ্জ্বল শক্তি, সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্য বিদ্যমান। নিছক লেখক হিসাবেও। অবনীন্দ্রনাথের মহিমা অসামান্য।

অবনীন্দ্রনাথের লেখকজীবন দীর্ঘ বিষয়বস্তুতে, রচনাশৈলীতে এবং রচনার মেজাজে বিচিত্র রূপসম্পন্ন। ক্ষীরের পুতুল’ ( ১৮৯৬ খ্রী) রচিত হইয়াছে সেই সব শিশুদের জন্য যাহারা হয়ত নিজেরা এখনও পড়িতে শিখে নাই। বয়সে আর ও দুই-তিন বৎসর বাড়িয়া ইহারা পড়িবে শকুন্তলা (১৮৯৫ খ্রী) ও ‘নালক’ ( ১৯১৬ খ্রী) প্রাচীন ভারতের জীবন তাহাদের সম্মুখে চিত্রায়িত হইবে সরল ও স্বচ্ছন্দ ভাষায়। আবার হয়ত এই বয়সের বালক-বালিকার কল্পনা উদ্বুদ্ধ হইবে ‘ভূতপত্রীর দেশ’ (১৯১৫ খ্রী) পাঠান্তে। এইভাবে ‘রাজকাহিনী' (১৯০৯ খ্রী, ১৯৩১ খ্ৰী )। ‘খাতাঞ্চির খাতা’ (১৯২১ খ্ৰী), বুড়ো আংলা’ (১৯৪১ খ্ৰী), ‘মাসি’ (১৯৫৪ খ্ৰী ), মারুতির পুথি’ (১৯৫৬ খ্র) প্রভৃতি নানা কাহিনী-গ্রন্থগুলি শৈশব হইতে প্রথম যৌবন অবধি নানাবয়সের চিত্তাবস্থায় বিমল আনন্দের সঞ্চার করে। ১৮৯৫ খ্রীষ্টাব্দে তাহার প্রথম বই শকুন্তলা' প্রকাশিত হয়, তাহার পরে তাহার দীর্ঘ জীবনকালে বহু গ্রন্থ ‘ভারতশিল্প’ ( ১৯০৯ খ্রী), ‘বাংলার ব্রত’ (১৯১৯ খ্ৰী ), ‘প্রিয়দর্শিকা’ (১৯২১ খ্রী), চিত্রাক্ষর’ (১৯২৯ খ্ৰী?), ‘ঘরােয়া’ (১৯৪১ খ্রী), ‘বাগেশ্বরী শিল্প-প্রবন্ধাবলী’ (১৯৪১ খ্ৰী ), ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ (১৯৪৪ খ্রী), সহজ চিত্ৰশিক্ষা’ (১৯৪৬ খ্র), ভারতশিল্পের ষড়ঙ্গ’ (১৯৪৭ খ্ৰী), ‘আলাের ফুলকি’ (১৯৪৭ খ্র), ভারতশিল্পে মূর্তি’ (১৯৪৭ খ্রী), একে তিন তিনে এক (১৯৫৪ খ্রী), ‘শিল্পায়ন’ (১৯৫৫ খ্র), ‘রং-বেরং’ (১৯৫৮ খ্রী), রচিত হইয়াছে। সাময়িকপত্রাদিতে প্রকাশিত অনেক রচনা তঁাহার মৃত্যুর পরে গ্রন্থাকারে সংকলিত হইয়াছে, কিছু বা এখন পর্যন্ত হয় নাই। দুইখানি গ্রন্থ, ‘ঘরােয়া ও ‘জোড়াসাঁকোর ধারে’ শ্রুতিধরীর লেখনীতে রচিত, কিন্তু এই দুইখানি গ্রন্থেই অবনীন্দ্রনাথের আপন ভাষা যেন টেপরেকর্ডে বিধৃত হইয়াছে। বুড়াে আংলা’ গ্রন্থে অনুপ্রেরণার সুদূর উৎস বিদেশী কাহিনীতে, কিন্তু অপরের বস্তুকে বেমালুম আপন করার এমন মসৃণ শিল্পক্ষমতা শেক্সপীয়রেও বিরল। সাহিত্যের যে অংশকে আমরা শিশুসাহিত্য বলিয়া অভিহিত

________________

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর | করি, যে সাহিত্যের আনন্দ বস্তুতঃ শিশু বা বালকের জন্যই নহে, বয়স্কদের জন্যও বটে, বাংলা সাহিত্যের সেই শাখায় | অবনীন্দ্রনাথের কৃতিত্ব চিরােজ্জ্বল এবং তুলনারহিত। তাহার প্রশস্ত প্রতিভায় যেন হান্স আনডারসেন, লিউইস ক্যারল, জেমস ব্যারি এবং আরও অনেক প্রতিভাধর বিদেশী লেখকের কল্পনাশক্তি সমন্বিত ও কেন্দ্রিত হইয়াছে দেশজ কথন-ঐতিহ্যের সঙ্গে। কাহিনীনির্বাচনে ও কাহিনীকথনে অবনীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণতঃ দেশজ ঐতিহ্যে নিষিক্ত। বঙ্গীয় কথকঠাকুর, ঘুমপাড়ানি দাসী, চাইবুড়ো- ইহাদের কথন পদ্ধতি অবনীন্দ্রনাথের গল্পগুলিতে বিধৃত হইয়াছে এবং দেশজ | বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বলিয়া এই গল্পগুলির বৈচিত্র্য অতুলনীয়। অবনীন্দ্রনাথের রচনায় একাধিক শৈলী প্রকট। কাব্য| ধর্মী গদ্যশৈলীর শ্রেষ্ঠ নিদর্শন তাহার প্রায় যাবতীয় গ্রন্থেই পাওয়া যায় বটে তথাপি এই নিদর্শনের সমৃদ্ধতম আকর চারিটি গ্রন্থে— ‘রাজকাহিনী’, ‘আলাের ফুলকি’, ‘বুড়ো আংলা’ ও ‘পথে বিপথে। অন্যত্র পাওয়া যায় কথাশৈলী, | যে শৈলী লক্ষ্য করিয়া রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছিলেন, “অবন যেন কথা কইছে আমি শুনতে পাচ্ছি।” এই কথাশৈলীর | কোথাও কোথাও সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ ও শ্লেষের দীপ্তি বিচ্ছুরিত হইয়াছে অথচ শ্লেযে কোনও নির্মমতা নাই। এই গদ্যের ধর্ম যখন যেমনই হউক না কেন তাহার প্রাণশক্তি | বাংলা ভাষার প্রাকৃত বাক্-রীতিতে। কাহিনীকথনের | মেজাজে, বাক-ভঙ্গীতে, কাহিনীরচনার ছাদে ও করণ| কৌশলে অবনীন্দ্রনাথ সম্পূর্ণতঃ প্রাকৃতপস্থী, তঁাহার শিল্পে

ও মনীষায় বিশুদ্ধ ভারতীয়তা অনন্যসাধারণ। ভারতীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে তাহার একাত্মতা কত সহজ ও নিবিড় ছিল তাহার অন্যতম সাক্ষ্য পাওয়া যায় শিল্পসম্বন্ধীয় | রচনাগুলিতে। | শিশু বা বালক-বালিকার জন্য অনেক কাহিনী রচনা করিয়াছেন বলিয়া যে অবনীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গী অগভীর ছিল এমন নয়। বস্তুতঃ চিত্রশিল্পে যেমন, সাহিত্যশিল্পেও তেমনই তাহার দূরপ্রসারী দিব্যদৃষ্টির পরিচয় পাই। একদা তিনি বলিয়াছিলেন, “মানুষী মূর্তির অ্যানাটমি দিয়ে মানস-মূর্তির অ্যানাটমির দোষ ধরতে যাওয়া মূখত।" অন্যত্র বলিয়াছিলেন, “ঐতিহাসিকের মাপকাঠি ঘটনামূলক •••আর রচয়িতা যারা তাদের মাপকাঠি অঘটন-ঘটনপটীয়সী মায়ামুলক।” অর্থাৎ শিল্পের কারবার স্কুল ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাস্তবতা লইয়া নয়, যদিও যে কোনও মানবিক অভিজ্ঞতার ন্যায় শৈল্পিক অভিজ্ঞতার মূলও বাস্তবে, শিল্পলােকে স্থূল বাস্তব রূপান্তরিত হয় পরাবাস্তবে। অবনীন্দ্রনাথের কাহিনীগুলি প্রাকৃত রসনিষিক্ত বটে কিন্তু
৮৩