পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/১১২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

________________

অবাধ নীতি শতাব্দীর প্রথমার্ধে বিদ্যাপতি অবহট্ঠ ভাষায় গদ্য-পদ্যে জীবনীকাব্য কীর্তিলতা রচনা করিয়াছিলেন। | অবহট্‌ঠে রচিত কিছু কিছু সাধারণ জ্ঞান শিক্ষা-শ্লোক ( আর্যা ) বাংলায় আধুনিক কাল পর্যন্ত চলিয়া আসিয়াছে। যেমন শুভংকরের নামে চলিত এই আর্যাটি কুড়বা কুড়বা কুড়বা লিজ্জে। কাঠায় কুড়বা কাঠায় লিজ্জে। মূলে হয়ত এইরকম ছিল— কুডবে কুডর্বে কুডবে লিজ্জই। কঠা কুডব কঠা লিজ্জই । খাটি বাংলায় এমনই হওয়া উচিত ছিল— কুড়ায় কুড়া কুড়ায় নিয়ে। কাঠায় কুড়া কাঠায় নিয়ে। সুকুমার সেন । অবাধ নীতি (laissez-faire) ইতিহাসের নিরবচ্ছিন্ন ধারাপ্রবাহে যুগবিশেষের স্বয়ংসম্পূর্ণতার দাবি আস্ফালন মাত্র। প্রতিটি যুগে এক দিকে বিগত দিনের প্রভাব, অন্য দিকে আগামী দিনের পূর্বাভাস প্রমূর্ত। দৃষ্টান্তস্বরূপ ১৫০০ হইতে ১৭৫০ খ্রীষ্টাব্দের অন্তর্বর্তী যুগের কথা উল্লেখ করা যাইতে পারে। এই যুগে বাণিজ্যতান্ত্রিক মতবাদ এবং মধ্যযুগীয় ভাবধারা যুগপৎ প্রভাব বিস্তার করিয়াছে। তথাপি বাণিজ্য-উদ্বৃত্ত বৃদ্ধির প্রয়াসে রাষ্ট্রীয় বাধানিষেধের যে কঠিন বেড়াজালে বাণিজ্যতান্ত্রিক যুগে অর্থনৈতিক কার্যকলাপকে পদে পদে ব্যাহত করিয়াছে তাহাকে উপেক্ষা করিয়াই ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী নবযুগের অঙ্কুর ধীরে ধীরে উদগত হইয়া উঠিয়াছে। অবাধ নীতি এক দিকে সরকার সম্পর্কীয় নূতন চিন্তাধারা অন্য দিকে আর্থিক চিন্তাজগতে বৈপ্লবিক সংস্কারের ইঙ্গিতবাহক মাত্র। অবাধ নীতির উদ্ভব হইয়াছিল বিশেষ কয়েকটি ঘটনার প্রভাবে। মােটামুটিভাবে এই ঘটনাগুলি হইতেছে : ১ উদীয়মান পুঁজিবাদী সম্প্রদায়, ২. ধর্ম, ৩. অ্যাডাম স্মিথ রচিত অর্থতত্ত্ব ও ৪. শিল্পবিপ্লব।

পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ অবধি শ্রেণী হিসাবে যে সম্প্রদায়ের স্থান নগণ্য, অষ্টাদশ শতাব্দীর অবসানের পূর্বেই সেই ব্যবসায়ী সম্প্রদায় সংখ্যায় এবং সম্পদে সমাজে প্রায় শীর্ষস্থানীয় হইয়া উঠিয়াছিল। উক্ত সম্প্রদায়ের এই প্রাধান্যলাভের মূলে ছিল উহার ক্ষিপ্র কর্মশক্তি আর সেই প্রগতির সুযােগ-সুবিধার চূড়ান্ত সদব্যবহারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। সেই যুগে নূতন দেশ আবিষ্কারের যে জোয়ার

________________

অবাধ নীতি আসিয়াছিল তাহাতে বাণিজ্য-সম্প্রসারণের নৃতন সম্ভাবনা এই কর্মশক্তিকে আরও প্রাণবন্ত করিয়া তুলিয়াছিল। নূতন বাণিজ্য এলাকার সন্ধানের সঙ্গে যুক্ত হইয়াছিল মূল্যস্তর বৃদ্ধির সম্ভাবনা, যাহার মূলে কাজ করিয়াছে স্পেন দেশ হইতে মূল্যবান বহু ধাতুর অপসারণ, আর ড্রেক, হকিন্স, ফ্রবিশার প্রমুখ ব্যক্তির মারাত্মক দস্যুবৃত্তি। সম্প্রসারিত বাণিজ্যের মুনাফায় তখন কেবলমাত্র উচ্চতর হারে পুজিসঞ্চয়ই ঘটে নাই; বণিক, বিক্রেতা, জাহাজ ও ব্যাঙ্ক -ব্যবসায়ী প্রত্যেকের ভাগ্যেই আসিয়াছিল শক্তি ও সমৃদ্ধি -লাভের অফুরন্ত সুযােগ। এই সময় সব চেয়ে লাভবান হইয়াছিল দুইটি জাতি- ইংরাজ ও ওলন্দাজ। উন্নতিশীল আর্থিক ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাচীন শিল্পসংস্থা তখন ক্রমশঃই অনুপযােগী হইয়া পড়িতেছিল। তাহার স্থান ধীরে ধীরে অধিকার করিয়া লইতেছিল ব্যক্তিগত প্রয়াসের আওতায় নৃতন শিল্পোদ্যোগ। গিল্ড-জাতীয় সংস্থার তখন প্রায় পূর্ণ অবসান ঘটিয়াছে। ব্যক্তিগত প্রয়াসের সমৃদ্ধিলাভের তখন সুবর্ণসুযােগ। শিল্পসংগঠনে এই বিপ্লবসাধনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আদর্শ জগৎ নূতন মূল্যবােধের সংঘাতে বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছিল। সংযত ও অনাড়ম্বর জীবনযাপনের আদর্শ এবং অর্থনৈতিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণে নৈতিক বিধিবিধান সম্পর্কিত মধ্যযুগীয় ধারণা ভাঙিয়া পড়িতে শুরু করিয়াছিল, আসিয়াছিল একান্ত ধনের জন্যই ধনস্পৃহার অভিনব নীতিবােধ। গােড়ার দিকে যদিও মূল্যবান ধাতুর সরবরাহ বৃদ্ধি এবং বাণিজ্য-উদ্ব ও সম্প্রসারণের খাতিরে এই নূতন নীতিবােধ ব্যবসায়-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের পক্ষে সমর্থন জানাইল তথাপি ইতস্ততঃ এই ব্যক্তিগত উপলব্ধির সৃষ্টি হইল যে, মুনাফাস্পৃহার চরিতার্থ| তার ব্যাপারে বাণিজ্যক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণমুক্তি একান্তই কাম্য।

মধ্যযুগে ধর্মের কাজ ছিল ব্যক্তির বিপক্ষে সমাজকে সমর্থন। খ্রীষ্টধর্মের অনুশাসনে তখন সমাজব্যস্থা নিয়ন্ত্রিত হইত, এমন কি নাগরিক জীবনের দৈনন্দিন আচার ব্যবহারেও ধর্মের প্রভাব ছিল সুস্পষ্ট। তথাপি এই কথা সত্য যে, বাণিজ্যবিস্তারের যে অনুকূল পরিবেশ তখন সৃষ্ট হইয়াছিল তাহার অনুপ্রেরণায় এবং মুনাফাবৃদ্ধির প্রয়াসে ব্যক্তিগত স্বাধীনতালাভের প্রচেষ্টা তখন সর্বপ্রকার বিরােধ অবরােধ অতিক্রম করিতে প্রস্তুত হইয়া উঠিয়াছিল। এই প্রচেষ্টার দুর্বার গতিবেগ এক দিকে যেমন আইনকানুন এবং জনমতকে আগাগােড়া রূপান্তরিত করিয়াছে অন্য দিকে তেমনই ধর্মের প্রভাব এবং অনুশাসনকেও প্রভূত পরিমাণে খর্ব করিয়াছে। তৎকালে সমস্ত নীতি এবং তত্ত্ব বণিক ও বিনিয়ােগকারীর স্বার্থসিদ্ধির কাজে নিয়ােজিত হইয়াছে।
৮৭