পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

________________

অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ মণ্ডলের মধ্যে প্রবেশ করে না সেইরূপ জীবগণও কখনও পরব্রহ্মের স্বরূপভূত হইয়া যায় না। এমন কি মুক্তাবস্থাতেও ভগবৎস্বরূপের সহিত জীবরূপের পার্থক্য থাকে। জীবাত্মা আয়তনে ভগবৎস্বরূপের ন্যায় বিভু বা সর্বব্যাপক নহে, মনুষাদির দেহের ন্যায় মধ্যমাকারও নহে; উহা অণুপরিমাণ। অণুপরিমাণ হইলেও উহা জড় নহে, চেতন। একবিন্দু চন্দন যেমন দেহের এক অংশে থাকিয়া সমগ্র দেহে স্নিগ্ধতার অনুভূতি প্রদান করে, সেইরূপ জীবাত্মা হৃদয়ে অবস্থান করিয়া সমগ্র দেহে চেতনা বিস্তার করিয়া থাকে। জীব শক্তি বিশিষ্ট পরব্রহ্ম যেমন চিস্তু, জীবও সেইরূপ চিদবস্তু। কিন্তু পরব্রহ্ম ও তঁাহার স্বাংশ ভগবৎস্বরূপগণ যেমন বিভুচিং, জীব সেইরূপ নহে। জীব অনুচিং। পরব্রহ্ম বিস্তীর্ণ জলন্ত অগ্নিরাশির তুল্য; জীব। একটি ক্ষুদ্র স্ফুলিঙ্গের তুল্য। জীব কবশে যে সকল মায়িক দেহ ধারণ করে তাহাদের উৎপত্তি ও বিনাশ আছে। কিন্তু জীবাত্মার জন্মও নাই মৃত্যুও নাই— জীবাত্মা নিত্য। জীবাত্মা সংখ্যায় অনন্ত। জীব শুধু জ্ঞানস্বরূপ নহে, তাহার জ্ঞাতৃত্বও আছে। কিন্তু সে পরব্রহ্মের ন্যায় সর্বজ্ঞ নহে। তাহার জ্ঞান সীমাবদ্ধ। | জীবের কর্তৃত্বও আছে ; কিন্তু তাহা পরমেশ্বরের অধীন। পরব্রহ্ম প্রযােজক কর্তা, জীব প্রযােজ্য কর্তা। পরব্রহ্মের শক্তির সহায়তা ব্যতীত জীব নিজের কর্তৃত্বকে বিকাশ করিতে পারে না। কর্তৃত্ব-বিকাশের ফলে যে কী অনুষ্ঠিত হয় সেই কর্মের দায়িত্ব ঈশ্বরের নহে, জীবের। ঈশ্বর কখনও সেই কর্মের ফল ভােগ করেন না; জীবকেই । কর্মফল ভােগ করিতে হয়। পরব্রহ্ম বা পরমেশ্বর শুধু কর্মের ফল দান করিয়া থাকেন। তিনি জীবকে যে কোনও প্রকার ইচ্ছা হৃদয়ে পোষণ করিবার শক্তি দিয়াছেন। কর্ম করিবার সময়ে জীব সেই শক্তিকে ব্যবহার করে। জীব পরমেশ্বরের অংশ বলিয়া ভগবানের স্বাতন্ত্র্যধর্মের কিয়দংশ জীবের মধ্যেও আছে। পরমেশ্বরের স্বাতন্ত্র বিভু, জীবের স্বাতন্ত্র্য অণু। পরমেশ্বর নিয়ন্তা, জীব নিয়ন্ত্রিত। এইজন্য অবস্থাবিশেষে জীবের অণুস্বাতন্ত্র পরমেশ্বরের বিভুস্বাতন্ত্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হইবার যােগ্য। সুতরাং জীবের স্বাতন্ত্র্য থাকিলেও তাহা অবাধ নহে। যে কোনও ইচ্ছা হৃদয়ে পােষণ করিবার শক্তি থাকিলেও সকল ক্ষেত্রে ইচ্ছানুরূপ কাজ করিবার শক্তি জীবের নাই। জীব যে কোনওরূপ ইচ্ছা হৃদয়ে পােষণ করিবে পরমেশ্বর তদন্থরূপ কাজ করিবার শক্তি প্রদান করিবেন, ইহাও আশা করা যায় না। ব্ৰহ্মাণ্ড সৃষ্টি করিতে ইচ্ছা করার শক্তি জীবের আছে; কিন্তু সেই ইচ্ছা কার্যে পরিণত করার________________

অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ | শক্তি তাহার নাই। ইহা হইতে বুঝা যায় যে, জীবের | স্বাতন্ত্র্য সীমাবদ্ধ। নিজের অবাধ স্বাতন্ত্র্য না থাকিলেও | জীব পরমেশ্বর প্রদত্ত অনুস্বাতন্ত্রকে কিয়ৎপরিমাণে যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করিতে পারে বলিয়া সে তাহার কর্মের জন্য | দায়ী হইয়া থাকে। জীবের দুইটি শ্রেণী আছে। এক শ্রেণীর জীব অনাদিকাল হইতে ভগবদুন্মুখ ; আর-এক শ্রেণীর জীব অনাদিকাল হইতেই ভগবহিমুর্থ। নিত্য ভগবদুন্মুখ জীবগণ অনাদিকাল হইতে পার্ষদরূপে ভগবানের সেবা করিয়া আসিতেছেন। তাহারা নিত্যমুক্ত। তাহাদের | দৃষ্টি ভগবানের স্বরূপ শক্তির দিকে। বহিমু খ জীবগণ অনাদিকাল হইতে মায়াজালে আবদ্ধ হইয়া আছে। | তাহাদের দৃষ্টি মায়া শক্তির বিলাসের দিকে। সুখাভিলাষী বহিমুর্থ জীব সুখস্বরূপ ভগবান্‌কে ভুলিয়া সুখের আশায় স্বেচ্ছায় দেহাত্মবুদ্ধিসম্পন্ন এবং কর্তৃত্বাভিমানী হইয়া মায়াময় সংসার ভােগ করিতে অগ্রসর হয় ; সে তাহার অণুস্বাতন্ত্র্যের অপব্যবহার করে। মায়া কখনও জীবের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাহাকে কবলিত করে না। মায়া ভগবানেরই শক্তি। বহিমুর্থ জীবকে নানাবিধ দুঃখ | প্ৰদান করিয়া ভগবদুন্মুখ করিবার উদ্দেশ্যেই মায়া তাহাকে | মুগ্ধ করিয়া থাকে। মায়া ভগবানের স্বরূপ শক্তির উপর

প্রভাব বিস্তার করিতে পারে না, কিন্তু তটস্থ শক্তিময় | জীবকে মুগ্ধ করিবার সামর্থ্য তাহার আছে। মায়া বিভুচিং ভগবৎস্বরূপকে আবৃত করিতে পারে না, কিন্তু অণুচিৎ জীবকে আবৃত করিতে পারে। নিত্যমুক্ত জীবেরাও তটস্থ শক্তিময় এবং অণুচিং। কিন্তু তাহাদিগকে কবলিত করিবার শক্তি মায়ার নাই, কারণ তাহারা ভগবানের স্বরূপ শক্তিদ্বারা অনুগৃহীত। বহিমুখ জীবগণের মধ্যে স্বরূপ শক্তির অনুগ্রহ নাই বলিয়া মায়া তাহাদিগকে কবলিত করিতে পারে। জীবের কৃষ্ণবহিমুখিতা অনাদি হইলে ও চিরস্থায়ী নহে। কৃষ্ণবহিমুখিতার ফলে যে মায়াবন্ধন ঘটে তাহাও জীবের স্বরূপানুবন্ধী নহে। উহা আগন্তুক ; সুতরাং দূরীভূত হওয়ার যােগ্য। ভগবদবিস্মৃতি দূর করিতে পারিলেই ভগবদ্ভহিমুখিতা দূর হয় ; ভগবদ্‌হিমুখিতা দুর হইলেই মায়াবন্ধন ছিন্ন হয়। ভগবদ্‌বিস্মৃতি দূর করিতে হইলে সর্বদা ভগবানকে স্মরণ করিবার চেষ্টা করিতে হয়; কিন্তু মায়ার প্রভাবে বিক্ষিপ্তচিত্ত জীব ভগবৎস্মৃতি হৃদয়ে স্থায়ী করিয়া রাখিতে পারে না।। | মায়ার প্রভাব হইতে অব্যাহতি লাভ করিবার একমাত্র উপায় শরণাগত হইয়া ভগবানকে ভজন করা। শাস্ত্রে কর্ম, যােগ, জ্ঞান, ভক্তি প্রভৃতি নানা প্রকার সাধনা ও

২৪