পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

________________

অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ স্তরকেই প্রেম আখ্যা দেওয়া হয়। প্রেম গাঢ়তা লাভ। করিতে করিতে যথাক্রমে স্নেহ, মান প্রণয়, রাগ, অনুরাগ, ভাব ও মহাভাব আখ্যা প্রাপ্ত হয়। যদিও রতি হইতে মহাভাব পর্যন্ত প্রত্যেকটি স্তরই সাধারণভাবে প্রেমের অন্তর্গত, তথাপি বিশেষ অর্থে উক্ত পর্যায়ের দ্বিতীয় স্তরকেই প্রেম বলা হইয়া থাকে। প্রেম গাঢ় হইয়া চিত্তকে দ্রবীভূত করিলে তাহাকে স্নেহ নামে অভিহিত করা হয়। স্নেহের উদয় হইলে ক্ষণকালের বিচ্ছেদও সহ্য হয় না। স্নেহ উৎকৃষ্টতা প্রাপ্ত হইয়া যখন কৌটিল্য বা অদাক্ষিণ্যরূপে আত্মপ্রকাশ করে তখন তাহাকে মান বলা হয়। যে মান উৎকৃষ্টতা প্রাপ্ত হইয়া প্রিয়জনের সহিত নিজের অভেদবিশ্বাসের সৃষ্টি করে তাহার নাম প্রণয়। প্রণয়ের উৎকর্ষ ঘটিলে কৃষ্ণলাভের সম্ভাবনায় অতিশয় দুঃখও সুখ বলিয়া অনুভূত হয়। প্রণয়ের এই উন্নত অবস্থার নাম। রাগ। যে রাগ নূতন নূতন হইয়া সর্বদা প্রিয়জনকে নূতন। রূপে অনুভব করায় তাহার নাম অনুরাগ। অনুরাগ যাবৎআশ্রয়বৃত্তি ও স্বসংবেদ্য দশা প্রাপ্ত হইলে তাহাকে ভাব বলা হয়। ভাবের পরাকাষ্ঠার নাম মহাভাব। মােদন ও মাদন নামে মহাভাবেরও দুইটি স্তর আছে। মাদনই প্রেমের সর্বোচ্চ স্তর। কৃষ্ণকান্তাশিরােমণি শ্রীরাধা ব্যতীত অপর কাহারও মধ্যে, এমন কি স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের মধ্যেও মাদনের অভিব্যক্তি নাই। শ্রীকৃষ্ণের সহিত মিলনে যত আনন্দবৈচিত্রীর সৃষ্টি হইতে পারে মাদনে তৎসমুদয়ের যুগপং অনুভব লাভ হয়। ইহাই মাদনের বৈশিষ্ট্য। ভক্তিমার্গের সাধক যতদিন স্কুলদেহে বিদ্যমান থাকেন ততদিন তাহার চিত্তে প্রেম অপেক্ষা উচ্চতর আর কোনও স্তরের আবির্ভাব হয় না। প্রাপ্তপ্রেম সাধকের দেহভঙ্গ হইলে তিনি যখন ভগবৎ-লীলাস্থলে জন্মলাভ করেন, তখন নিত্যসিদ্ধ পরিকরদিগের সঙ্গ প্রভাবে তাহার মনে স্নেহমান-প্রণয়াদির আবির্ভাব হইতে পারে। কৃষ্ণপ্রেম ব্ৰহ্মানন্দ অপেক্ষাও অনন্ত গুণ শ্রেষ্ঠ। ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মােক্ষ ইহার তুলনায় তুচ্ছ। ইহা জীবের পঞ্চম পুরুষার্থ । ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অজ হইয়াও তাহার অচিন্ত্যশক্তির। সাহায্যে জন্মগ্রহণ করিয়া থাকেন, আপ্তকাম হইয়াও কর্মে প্রবৃত্ত হইয়া থাকেন। তিনি স্বাধীন। তাহার জন্ম অবিদ্যা, কাম অথবা কর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নহে। তিনি পূর্ণ। তাঁহার কর্ম অভাববােধজনিত নহে। তাহার জন্ম কর্মকে লীলা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। তাঁহার পিতা-মাতা প্রভৃতি তাঁহারই শুদ্ধ সত্ত্বের প্রকাশ। প্রকট ও অপ্রকট ভেদে তাঁহার লীলা দুই প্রকার। যে লীলা কখনও লােকচক্ষুর গােচরীভূত হয় না তাহাই অপ্রকট লীলা। তিনি কৃপা________________

অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ করিয়া যে লীলা কখনও কখনও লােকনয়নের গােচরীভূত করেন তাহার নাম প্রকটলীলা। ভক্তের প্রেমরসনির্যাস আস্বাদন এবং তার জগতে রাগমার্গের ভক্তি প্রচার করিবার উদ্দেশ্যে তিনি ব্রজলীলা প্রকটিত করেন। প্রকটলীলায় সকল রস অপেক্ষা কান্তারসের বৈচিত্রীই অধিক। স্বকীয়া ও পরকীয়া ভেদে কান্তা দুই প্রকার। পরস্পর | বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ পতি-পত্নীর মধ্যে যে ভাব থাকে তাহার নাম স্বকীয়া কান্তাভাব। বৈধ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ নহে, এইরূপ যুবক-যুবতীর মধ্যে পরস্পরের প্রতি যে অনুরাগ লক্ষিত হয় তাহার নাম পরকীয়া কান্তাভাব। অপ্রকট ব্রজলীলায় শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীরাধিকাদির নিত্য স্বকীয় ভাব। স্বকীয় ভাবের নায়ক-নায়িকার মিলনে গুরুতর বাধাবিঘ্ন কিছু না থাকায় আনন্দচমংকারিতা বর্ধিত হয় না। এইজন্য প্রকটলীলায় কৃষ্ণশক্তি যােগমায়া শ্রীকৃষ্ণের ও শ্রীরাধিকাদির নিত্য সম্বন্ধের জ্ঞান আচ্ছাদিত করিয়া তাহাদের মধ্যে পরকীয়া ভাবের সৃষ্টি করেন। | বঙ্গীয় বৈষ্ণবাচার্যগণ প্রধানতঃ শাস্ত্রোক্তির উপর নির্ভর করিয়া কৃষ্ণের শক্তি ও গুণ, জীবাত্মার স্বরূপ ও স্বাভাবিক ধর্মাদি বিষয়ের আলােচনা করিয়াছেন। শ্রুতিতে জীব ও পরব্রহ্মের ভেদবাচক বাক্য আছে ; আবার উভয়ের অভেদবাচক বাক্যও আছে। সুতরাং জীব ও ব্রহ্মের ভেদ ও অভেদ উভয়ই সত্য। জীব ভেদাভেদসম্বন্ধে ভগবানেরই প্রকাশ। জীবকে পরব্রহ্মের সহিত অভিন্ন বলিবার হেতু এই যে জীব ও পরব্রহ্ম উভয়ই চিস্তু। আবার জীবকে পরব্রহ্ম হইতে ভিন্ন বলিবার হেতু এই যে জীবের স্বরূপগত ধর্ম পরব্রহ্মের স্বরূপগত ধর্ম হইতে পৃথক। উভয়েই চিবস্তু সন্দেহ নাই, কিন্তু জীব অণুচিং, পরব্রহ্ম বিভুচিং। জীব অল্পজ্ঞ, অল্প শক্তিমান ; পরব্রহ্ম সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান। জীব মায়ার বশীভূত হওয়ার যােগ্য ; পরব্রহ্ম মায়ার বশীভূত হওয়ার যােগ্য নহেন, তিনি মায়াধীশ। জীবের দেহ মায়িক জগতের উপাদান দ্বারা গঠিত। পরব্রহ্মের বিগ্রহে মায়িক উপাদান নাই। জীব জগতের স্রষ্টা নহে; পরব্রহ্ম মায়াযােগে জগৎ সৃষ্টি করিয়া থাকেন। জীব অংশ, পরব্রহ্ম অংশী। অংশ ও অংশীর মধ্যে ভেদ এবং অভেদ উভয়ই থাকে। ইহারা সর্বতােভাবে ভিন্নও নহে, সর্বতােভাবে অভিন্নও নহে। সুতরাং জীব ও পরব্রহ্মের সম্বন্ধে যুগপৎ ভেদবাচক ও অভেদবাচক শ্রুতির প্রামাণ্য অস্বীকার করা যায় না।

বঙ্গীয় বৈষ্ণবাচাৰ্যদিগের মতে জীব-জগদাদি সমস্তই পরব্রহ্মের শক্তি। আমরা যাহাকে জীব বলি, সেই জীব পরব্রহ্মের জীবশক্তির অংশ ব্যতীত আর কিছুই নহে। আমরা

২৬