পাতা:ভারতকোষ - প্রথম খণ্ড.pdf/৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
অদ্বৈতবাদ
অধরলাল সেন

ভ্রান্তির মূল। চৈতন্যস্বরূপ আত্মাই জগতের তথাকথিত কারণ। আত্মাই জীবের বুদ্ধিতে প্রবিষ্ট হইয়া জ্ঞাতা, তিনিই বিষয়বিশিষ্টরূপে বিষয়কে উদ্ভাসিত করিয়া জ্ঞেয় হন, আবার তিনিই জ্ঞানস্বরূপ। জগতের প্রত্যেকটি খণ্ডজ্ঞানই অখণ্ডচৈতন্যের বিভিন্ন রূপে প্রকাশমাত্র। জগৎ মায়িক বলিয়া ইহার পারমার্থিক সত্তা নাই, কিন্তু জগৎ অলীকও নহে। কারণ অলীক বস্তুর প্রকাশ হয় না বা তাহার অপরােক্ষ জ্ঞান হয় না। কূটস্থ চৈতন্য লীলাবশতঃ জগৎ ও জীব সৃষ্টি করিয়াছিলেন এবং যতক্ষণ না প্রকৃত জ্ঞানের দ্বারা জগতের যথার্থ স্বরূপ অবগত হওয়া যায়, ততক্ষণ ইহার ব্যাবহারিক সত্তা অস্বীকার করার উপায় নাই। ঈশ্বর হইতে আরম্ভ করিয়া তৃণগুল্ম পর্যন্ত প্রত্যেকটি জাগতিক বস্তুরই অস্তিত্ব ব্যাবহারিক মাত্র, পারমার্থিক নহে। একমাত্র আত্মাই যথার্থ পারমার্থিক সত্য। এই জগভ্রমকে বুৰ্জ্জুতে সর্পভ্রমের সঙ্গে তুলনা দেওয়া যায়। অন্ধকারাবৃত রজ্জ্বর স্বরূপ জানিয়া অস্পষ্ট বস্তুটিতে সর্পত্বের আরােপ করিয়া লােক যেমন ভীতচকিত হয়, তেমনই সদাত্মার স্বরূপ অবিদ্যাচ্ছন্ন থাকায় কেবল সৎ-রূপে প্রকটিত আত্মায় জগৎপ্রপঞ্চের আরোপ করিয়া আমরা সংসারমােহে আবদ্ধ হইয়া থাকি। এই অবিদ্যা ত্রিগুণত্মিক সদসহিভূত অনির্বচনীয়। এই অবিদ্যাই জীবকে মােহাচ্ছন্ন করিয়া রাখে।

শংকরাচার্য অদ্বৈতবাদের ভিত্তিমাত্র স্থাপন করিয়া ছিলেন। তাঁহার সুযােগ্য শিষ্যগণ সূক্ষ্ম খণ্ডন-মণ্ডনের দ্বারা এই দর্শনকে অত্যন্ত শক্তিশালী ও জনপ্রিয় করিয়া তােলেন। তাহার শিষ্যদের মধ্যে পদ্মপাদাচার্য, সুরেশ্বরাচার্য ও মণ্ডন মিশ্রের নাম বিখ্যাত। শেষােক্ত পণ্ডিতদ্বয় একই ব্যক্তিও হইতে পারেন। প্রকাশাত্মযতি পদ্মপাদাচার্যের পঞ্চপাদিকার উপর বিবরণ নামক টীকা রচনা করিয়া এবং অখণ্ডান বিবরণের টীকা রচনা করিয়া বেদান্তদর্শনের অদ্বৈতবাদের বিবরণ-প্রস্থান স্থাপন করেন। সুরেশ্বরাচার্যের শিষ্য সর্বজ্ঞতাত্মমুনি সংক্ষেপ শারীরক রচনা করেন। বাচস্পতি মিশ্র ব্রহ্মপুত্রের শংকরভাষ্যের উপর ভামতী টীকা রচনা করিয়া ভামতী-প্রস্থান স্থাপন করেন। অমলানন্দ ভামতীর উপর কল্পতরু টীকা ও তদুপরি অঞ্চয় দীক্ষিত পরিমল টীকা রচনা করিয়া বাচস্পতির মত দৃঢ় করেন। আনন্দবােধতি, শ্রীহর্ষ ও চিংসুখাচার্য নব্যন্যায়ের আদর্শে খণ্ডনাত্মক রীতি অনুসরণ করিয়া অন্যান্য দাশনিকদের আক্রমণ হইতে অদ্বৈতবাদকে রক্ষা করিবার চেষ্টা করেন। এই রীতির পরাকাষ্ঠা মধুসূদন সরস্বতীর অদ্বৈতসিদ্ধি গ্রন্থে মূর্ত হয়। এতদ্ব্যতীত প্ৰকটার্থ
বিবরণকার, বিমুক্তাত্ম, বিদ্যারণ্য মুনি, রামাদ্বয়,

নৃসিংহাশ্রম মুনি, প্রকাশানন্দ সরস্বতী প্রভৃতি বিশ্রুত আচার্যগণ পরমত খণ্ডন করিয়া অদ্বৈততত্ত্ব স্থাপন করেন। খ্রষ্টীয় অষ্টম বা নবম শতক হইতে অদ্বৈতবাদের জয়যাত্রা শুরু হইয়া সুদীর্ঘকাল অব্যাহত গতিতে অগ্রসর হইয়া খ্ৰীষ্টীয় যােড়শ শতকে প্রতিষ্ঠার চূড়ায় আরােহণ করে। | কিন্তু তাহার পর আর কোনও মােলিক গ্রন্থ রচিত হয় নাই- ‘অচিন্ত্যভেদাভেদ’, ‘অবিদ্যা’, ‘দ্বৈতবাদ’, ‘দ্বৈতা| দ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ’, ‘বেদান্ত’, ‘মায়াবাদ’ দ্র।

দ্র আশুতােষ শাস্ত্রী, বেদান্ত দর্শন—অদ্বৈতবাদ ১ম, ২য় ও ৩য় খণ্ড, কলিকাতা, ১৯৪২, ১৯৪৯, ১৯৬১ খ্ৰী;V. P. Upadhyay, Lights on Vedanta, Varanasi, 1959; G. R. Malkani, Metaphysics of Advaita Vedanta, 1961; Anilkumar Roy Choudhuri, Self and Falsity, 1955.

সংযুক্তা গুপ্ত

অধরচাঁদ যে চাদ সহজে ধরা দেন না- বাউলদের আত্মারূপী আল্লাহ, সহজ মানুষ, মনের মানুষ। অধরকে ধরা বা উপলব্ধি করাই বাউলের কাম্য।বাউল গানে অধরচঁাদের নামান্তর আছে- মনের মানুষ, সহজ মানুষ, অটল মানুষ, আলেক মানুষ, ভাবের মানুষ ইত্যাদি। মূলতঃ ইহা ব্যক্তির অন্তরতম সত্তা। বাউলগণ ইহাকে স্বতন্ত্র ঈশ্বরও মনে করিয়াছেন। লালন ফকির দুইটি পঙক্তিতে ভাবটি সুন্দর ফুটাইয়াছেন:

‘জলে যেমন চাঁদ দেখা যায়,
ধরতে গেলে হাতে কে পায়?

দ্র ক্ষিতিমােহন সেন, বাংলার বাউল, কলিকাতা, ১৯৫৪ খ্ৰী; উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, বাংলার বাউল ও বাউল গান, কলিকাতা, ১৯৫৭।

অধরলাল সেন (১৮৫৫-১৮৮৫ খ্রী) উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের উদীয়মান বাঙালী কবি, কলিকাতার সম্রান্ত সুবৰ্ণবণিক পরিবারের সন্তান। সফলতার বীজ অঙ্কুরিত হইবার পূর্বেই দুর্ঘটনার ফলে অকালে তাহার মৃত্যু হয়। স্বল্পায়ু জীবনে অধরলাল মাতৃভাষায় পাঁচখানি কাব্য এবং ইংরেজীতে তথ্যমূলক একখানি গ্রন্থ প্রকাশ করিয়া গিয়াছেন। তাহার ছাত্রজীবন বেশ উজ্জ্বল ছিল। ডেপুটি কালেক্টর রূপে রাজকার্য করিয়া তিনি সুনাম অর্জন করেন। তিনি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো এবং
৪৬