পাতা:মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা.pdf/১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১০
মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা

দ্রষ্টব্য। যে কেউ এই প্রবন্ধদ্বয় পাঠ করলেই বুঝতে পারবেন যে ভারতবর্ষ সম্বন্ধে মার্কসের জ্ঞান ছিল নিতান্ত ভাসা ভাসা এবং ভারতের জলবায়ু সম্পর্কেও তাঁর কোনো ধারণা ছিল না। “ভারতে বৃটিশ শাসন” প্রবন্ধের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, “আবহাওয়া ও আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যের জন্য, বিশেষ করে সাহারা থেকে শুরু করে আরব, পারস্য, ভারত ও তাতারিয়ার মধ্য দিয়ে সমুন্নত এশীয় মালভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত বৃহৎ বৃহৎ মরু অঞ্চলের অস্তিত্বের ফলে খাল ও জলাশয় থেকে কৃত্রিম সেচ ছিল প্রাচ্য কৃষির ভিত্তি। যেমন মিশর ও ভারতে, তেমনি মেসোপটেমিয়া, পারস্য প্রভৃতি দেশেও বন্যার জল দিয়ে ভূমির উর্বরতা সাধন করা হয়,....” এ থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ভারতের কৃষি যে মূলত জলসেচের বদলে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ুর দ্বারা সৃষ্ট বৃষ্টির জলের উপর নির্ভরশীল, এই সাধারণ তথ্যটিও মার্কসের জানা ছিল না।

 আর পাঁচটা সাধারণ ইয়োরোপীয়ের মত মার্কসও মনে করতেন যে একমাত্র ইয়োরোপীয় সমাজই পৃথিবীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুসভ্য ও সংস্কৃতি-সম্পন্ন জাতি। তাই মার্কসের চোখে ভারতবর্ষ একটা অর্ধনগ্ন, অসভ্য, জংলীদের দেশ ছাড়া আর কিছুই নয় এবং ভারতীয়দের ধর্মও নানা রকম দেবদেবী, পুতুল, গাছপালা বা প্রকৃতি পূজনকারী একটা জংলী বা pagan ধর্ম বিশেষ। সুপ্রাচীন কাল থেকে ভারতের হিন্দুরা যে মহান সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে সে বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকার ফলেই মার্কস লিখতে পারলেন যে, “ভারতীয় সমাজের কোনো ইতিহাস নেই। ভারতের ইতিহাস বলতে যা বোঝায় তা শুধু একের পর এক বহিরাক্রমণকারীর ইতিহাস, যারা ঐ অপ্রতিরোধী ও অচলায়তন সমাজের নিষ্ক্রিয় ভিত্তির উপর তাদের সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছে।” তিনি আরও বিশ্বাস করতেন যে, ঐ সব পুরানো আক্রমণকারীরা সকলেই ছিল বর্বর ও তাতার, তাই তারা কালক্রমে নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে ভারতীয় সমাজের সঙ্গে মিশে গিয়েছে এবং একমাত্র “বৃটিশরাই হল প্রথম বিজয়ী যারা সভ্যতায় হিন্দুদের চেয়ে উন্নত এবং সেই হেতু তার কাছে অনধিগম্য।”

 এখানে আমাদের সর্বদা স্মরণ রাখতে হবে যে, মার্কস হলেন সেই ইয়োরোপীয় সমাজের প্রতিনিধি যাদের অভিধানে শ্রদ্ধা, সাধনা, ভক্তি, মোক্ষ ইত্যাদি শব্দের কোনো প্রতিশব্দ নেই। সত্ত্বঃ, রজঃ ও তমঃ গুণ সম্বন্ধে যাদের কোনো ধারণা নেই; সাত্ত্বিক জীবনযাত্রা বা সাত্ত্বিক আহার-বিহারের ধারণা যাদের কাছে নিতান্তই দুর্বোধ্য; বস্তুগত ভোগের সামগ্রী হস্তগত করে ভোগ করা এবং লালসার চরিতার্থতাই যাদের জীবনের চরম লক্ষ্য এবং এই উদ্দেশ্যে যারা আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যাণ্ড ইত্যাদি দেশ ও মহাদেশের আদিম অধিবাসীদের নির্বিচারে হত্যা করে নিঃশেষ করে ফেলেছে; আফ্রিকার অধিবাসীদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে, বন্দী করে নিয়ে গিয়ে আমেরিকার বাজারে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করেছে; নীল চাষের আমলে আমাদের দেশের কৃষক সমাজের উপর অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছে; কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করে লক্ষ লক্ষ কৃষক পরিবারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছে এবং জালিয়ানওয়ালাবাগের মত জঘন্য হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে। এইসব সুসভ্য (?) জাতিদের ধর্ম শিক্ষা দেয় যে পৃথিবীর উপর প্রভুত্ব করার জন্যই ভগবান পৃথিবীতে তাঁদের পাঠিয়েছেন। তাই নির্বিচারে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে তারা পৃথিবীকে মনুষ্যবাসের অযোগ্য করে তুলেছে। এদের অত্যাচারে বহু প্রজাতির জীবজন্তু আজ পৃথিবী থেকে চিরতরে লুপ্ত হয়ে গিয়েছে এবং আরও বহু প্রজাতি লুপ্ত হবার আশঙ্কায় দিন গুনছে।