পাতা:মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা.pdf/২২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মার্কস ও মার্কসবাদীদের অজ্ঞতা
২১

“সনাতন ধর্ম বা হিন্দু ধর্মই হল আমাদের জাতীয়তাবাদ। এই হিন্দু জাতি সনাতন ধর্ম সাথে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছে, এবং সনাতন ধর্মকে সাথে নিয়েই সে অগ্রসর হচ্ছে এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হচ্ছে” (উত্তরপাড়া অভিভাষণ)।

 কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর “আত্মপরিচয়” প্রবন্ধে লিখছেন, “বর্তমানকালে আমরা কেহ কেহ এই লইয়া চিন্তা করিতে আরম্ভ করিয়াছি, আমরা যে কী, সে লইয়া আমাদের মনে একটা সন্দেহ জন্মিয়াছে। আমরা আর কিছুই নই, আমরা ব্রাহ্ম। কিন্তু সে তো একটা নূতন পরিচয় হইল। সে পরিচয়ের শিকড় তো বেশিদূর যায় না?....ইহার চেয়ে পাকা পরিচয়ের ভিত্তি কি আমার কিছুই নাই? অতীতকাল হইতে প্রবাহিত একটা নিত্য লক্ষণ কি আমার মধ্যে একেবারেই বর্তায় নাই?...অতএব আমি হিন্দু, এ কথা বলিতে যদি নিতান্তই কোন লজ্জার কারণ থাকে, তবে সে লজ্জা আমাকে নিঃশব্দে হজম করিতে হইবে।” কবি আরও লিখছেন, “তবে কি মুসলমান ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ে যোগ দিলেও তুমি হিন্দু থাকিতে পার? নিশ্চয়ই পারি। ইহার মধ্যে পারাপারির তর্কমাত্রই নাই। ...ইহা সত্য যে কালীচরণ বাঁড়ুজ্জে মহাশয় হিন্দু-খ্রিস্টান ছিলেন, তাহার পূর্বে জ্ঞানেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় হিন্দু-খ্রিস্টান ছিলেন, তাঁহার পূর্বে কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় হিন্দু-খ্রীষ্টান ছিলেন। অর্থাৎ তাঁহারা জাতিতে হিন্দু ধর্মে খ্রিস্টান ছিলেন। খ্রিস্টান তাহাদের রঙ, হিন্দুই তাহাদের বস্তু। বাংলাদেশে হাজার হাজার মুসলমান আছে, হিন্দুরা তাহাদের অহর্নিশি “হিন্দু নও, হিন্দু নও” বলিয়াছে এবং তাহারাও নিজদিগকে “হিন্দু নই, হিন্দু নই” শুনাইয়া আসিয়াছে। কিন্তু তৎ সত্ত্বেও তাহারা প্রকৃতই হিন্দু-মুসলমান।....মুসলমান একটি বিশেষ ধর্ম, কিন্তু হিন্দু কোন বিশেষ ধর্ম নহে, ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক জাতিগত পরিণাম।”

 গীতা বলছে, “যদ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ” (৩/২১), অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যাহা যাহা আচরণ করেন, অপর সাধারণেও তাহাই করে।” কাজেই প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, ভারতের আপামর জনসাধারণ কোন্ শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে অনুসরণ করবে? ভারতবর্ষের মানুষ কি এই ভারতেরই সন্তান, সত্যদ্রষ্টা ঋষি অরবিন্দ বা শ্রীরবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করবে, না কি জার্মানিতে জন্মগ্রহণকারী এবং ভারত সম্পর্কে নিতান্ত অজ্ঞ মার্কসকে অনুসরণ করবে? ভারতবর্ষের মানুষ কি মার্কসের কথামত হিন্দুত্বকে আফিমের মত বর্জন করবে, না রবীন্দ্রনাথ ও অরবিন্দের কথামত হিন্দুত্বকে জাতির মূল জীবনীশক্তি হিসাবে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে থাকবে? বিবেকানন্দও এ ব্যাপারে জাতিকে সতর্ক করে দিয়ে বলে গেছেন, “তোমরা যদি ধর্ম ছাড়িয়া পাশ্চাত্য জাতির জড়বাদ-সর্বস্ব সভ্যতার অভিমুখে ধাবিত হও, তোমরা তিন পুরুষ যাইতে না যাইতেই বিনষ্ট হইবে। ধর্ম ছাড়িয়া দিলে হিন্দুর জাতীয় মেরুদণ্ডই ভাঙ্গিয়া যাইবে। ফল দাঁড়াইবে সম্পূর্ণ ধ্বংস।” (বিবেঃ রচঃ, উদ্বোধন, জন্মশতবর্ষ সং, ৫ম খণ্ড, পৃঃ-৬৮।)

 কিন্তু দেশের প্রতি শ্রদ্ধাহীন, জাতির প্রতি শ্রদ্ধাহীন, সর্বোপরি নিজের দেশের মহাপুরুষদের প্রতি শ্রদ্ধাহীন দেশদ্রোহী মার্কসবাদীরা সত্যদ্রষ্টা দেশের মহামানবদের কথা বা উপদেশকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে ভারতবর্ষ সম্পর্কে অজ্ঞ, বিদেশী ও জড়বাদী মার্কসের বাণীকেই অভ্রান্ত বলে মেনে নিল এবং হিন্দুত্বকে আফিমের মতই বর্জন করল। হিন্দুত্বকে অস্বীকার করে তারা জাতীয় ঐক্যের মূল ভিত্তিকেই অস্বীকার করল। বিবেকানন্দের ভাষায়, জাতির মেরুদণ্ডকেই অস্বীকার করল। ফল দাঁড়াল ভারত সম্পর্কে মার্কসবাদীদের সীমাহীন অজ্ঞতা। এই কারণেই স্বাধীনতার প্রাক্কালে তারা বলতে পেরেছিল যে, ভারতে ষোলটি জাতি বাস করে এবং তাদের