পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/১২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
লুৎফ উন্নেসা
১২৩

জন্য আহার প্রস্তুত করিবার ভার লয়। কিন্তু সে গোপনে মীরজাফরের জামাতা মীর কাসেম ও ভ্রাতা মীর দাউদকে সংবাদ দিলে, তাঁহারা সিরাজকে ধৃত করিয়া মুর্শিদাবাদে পাঠাইয়া দিলেন। ঐ সকল কর্মচারী স্ত্রীলোকদিগের নিকট হইতে যাবতীয় ধনরত্নাদি অপহরণ করেন। মীর কাসেম লুৎফ উন্নেসার নিকট হইতে যাবতীয় সম্পত্তি লুণ্ঠন করিয়াছিলেন।

 মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হওয়ার পর, হতভাগ্য সিরাজ মীরণের আদেশক্রমে মহম্মদী বেগের তরবারির আঘাতে খণ্ডবিখণ্ডিত হইয়া খোসবাগের বৃক্ষচ্ছায়ায় চিরদিনের জন্য সমাহিত হইলেন। তাঁহার পরিবারবর্গের দুর্দশা শ্রবণ করিলে, হৃদয় স্তম্ভিত হইয়া উঠে। নবাব আলিবর্দী খাঁর বেগমকে তদীয় কন্যাদ্বয় ঘসেটী ও আমিনার সহিত চিরনির্বাসিতা করা হইল। সেই সঙ্গে পতিবিয়োগবিধু্রা অভাগিনী লুৎফ উন্নেসাও চারি বৎসরের কন্যা উম্মত জহুরাকে লইয়া মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করিতে বাধ্য হন।[১] প্রথমে তাঁহাদিগকে যৎপরোনাস্তি লাঞ্ছনার সহিত কারারুদ্ধ করিয়া, পরে নির্বাসনের দেখিলে সকলে বুঝিতে পারিবেন। “This man (Shah Dana) whom probably he had either disobliged or oppressed in the days of his full power, rejoiced & c. মুতাক্ষরীনকারের মতে দানাশাহের প্রতি সিরাজ অত্যাচার করিয়াছিলেন কিনা তাহার স্থিরতা নাই। কিন্তু ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ লিখিলেন যে, একেবারে তাহার কান কাটিয়া দেওয়া হয়। ধন্য সত্যানুসন্ধিৎসু ইংরেজ ঐতিহাসিকগণ! রিয়াজুস সালাতন গ্রন্থে লিখিত আছে,—সিরাজ ভগবানৃগোলা হইতে পদ্মা পার হইয়া মালদহ পর্যন্ত যান, পুরাতন মালদহের নিকট বড়াল নামক স্থানে দানাশাহের সহিত তাঁহার সাক্ষাৎ হয়। হণ্টার বলেন যে, সিরাজকে ধৃত করার জন্য দানাশাহ মীরজাফরের নিকট হইতে জায়গীর পাইয়াছিল। কিন্তু বাবু উমেশচন্দ্র বটব্যাল বলেন যে, দানাশাহের বংশীয়েরা যে নিষ্কর ভূমি ভোগ করে, তাহ গৌড়ের প্রসিদ্ধ বাদশহ হোসেন শার দত্ত। বটব্যাল মহাশয় লিখিয়াছেন —"যেস্থানে সিরাজউদ্দৌলা ধৃত হইলেন, ঐ স্থান কালিন্দীতীরবর্তী; উহ! তদবধি “সূবামার” নামে বিখ্যাত। স্থানীয় লোকে তাহার “শুওরমারা” নাম দিয়াছে। হায় বিধাতঃ, মূর্খের জিহ্বাতে তুমি সুবা সিরাজউদ্দৌলাকে শূকরে পরিণত করিয়াছ!” সাহিত্য—১৩০১ মাঘ “লক্ষণাবতী” প্রবন্ধ পৃ ৬৫o।) বাবু অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় দানাশাহের বংশধরগণের নিকট হইতে প্রমাণ সংগ্রহ করিয়া ও তাঁহার সমাধির ফলকলিপির সাহায্যে স্থির করিয়াছেন, মালদহ অঞ্চলের প্রসিদ্ধ দানাশাহ সে সময়ে জীবিত ছিলেন না। কিন্তু সমসাময়িক মুতাক্ষরীনকার ও রিয়াজ গ্রন্থকারের উক্তিতে উক্ত ফকীরের দানাশাহ নামই হইতেছে। রিয়াজ গ্রন্থকার অনেকদিন পর্যন্ত মালদহ অঞ্চলে বাসও করিয়াছিলেন। সুতরাং এরূপ স্থলে এই প্রকার অনুমান হয় যে, সিরাজের ধৃতকারী ফকীরের নাম দানাশাহ হইতে পারে। কিন্তু সে প্রসিদ্ধ দানাশাহ হইতে বিভিন্ন ব্যক্তি। মুতাক্ষরিনে দানাশাহকে একজন সামান্য ফকীর বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। প্রসিদ্ধ দানাশাহ হইলে তাহার বর্ণনা অন্যরূপ হইত।

  1. মজঃফরনামায় লিখিত আছে যে, সিরাজের মৃত্যুর পর তাহার বেগমদিগের নিকট স্ব-স্ব-পাত্র নির্বাচন করিয়া লইয়ার প্রস্তাব করিলে, লুৎফ উন্নেসা স্বগর্বে উত্তর করিয়াছিলেন,— “হন্তিপূণ্ঠে আরোহণে অভ্যস্ত লোক কোথায় গর্দভবাহন বাঞ্ছা করে?”