পাতা:মুর্শিদাবাদ কাহিনী.djvu/৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
জগৎশেঠ
৪৩

পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রে ইংরেজরা জয়ী হইয়া, মীরজাফরকে মসনদে বসাইলে, সিরাজ রাজমহলের নিকট হইতে ধৃত হইয়া মুর্শিদাবাদে আনীত হন। তাহার পর মহম্মদী বেগের তরবারির আঘাতে তাঁহার দেহ হইতে মস্তক বিচ্ছিন্ন হইয়া ভূতলে পতিত হয়। কোন দেশীয় গ্রন্থকার বলেন যে, জগৎশেঠ ও ইংরেজ সর্দার সিরাজের হত্যকাণ্ডের জন্য মীরজাফরকে উত্তেজিত করিয়াছিলেন[১] ইহার সত্যাসত্য সাহস করিয়া বলিতে পারা যায় না। যদি এ ঘটনা সত্য হয়, তাহা হইলে, জগৎশেঠ মহাতপচাঁদের নাম যে চিরকলঙ্কিত হইয়া থাকিবে, তদৃবিষয়ে অণুমাত্র সন্দেহ নাই। যে-হতভাগ্য রাজ্যহারা, সর্বস্বহার হইয়া অবশেষে আপনার প্রাণভিক্ষার জন্য প্রত্যেকের পদতলে বিলুষ্ঠিত হইয়াছিল, তাহার প্রাণদানের পরিবর্তে যদি প্রাণনাশে কেহ সম্মতিমাত্র দিয়া থাকে, তাহা হইলে তাহার ন্যায় ঘৃণিত ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির লোক যে সর্বথা নিন্দনীয়, এ কথা মুক্তকণ্ঠে বলা যাইতে পারে। ক্লাইবের ন্যায় কঠোরপ্রকৃতি ইংরেজ-সর্দারের এ প্রবৃত্তি শোভা পাইতে পারে, কিন্তু জগৎশেঠের ন্যায় উচ্চবংশসদ্ভূত ব্যক্তির এ প্রবৃত্তি কদাচ সাধুজনপ্রশংসনীয় হইতে পারে না। ক্লাইব যে ঐরূপ ঘৃণিত কার্য করিয়াছিলেন, তাহাতেও আমাদের ঘোরতর সন্দেহ আছে।

 পলাশীর যুদ্ধের পর মীরজাফর মুর্শিদাবাদের মসনদে উপবিষ্ট হন। তাঁহার সিংহাসনারোহণের পরেই সন্ধির প্রস্তাবনুযায়ী অর্থাদির নিম্পত্তি আরম্ভ হয়। পলাশীর যুদ্ধের সাত দিবস পরে ১৭৫৭ খ্রীঃ অব্দের ৩০শে জুন মহিমাপুরে শেঠদিগের বাটতে সমস্ত বিষয়ের মীমাংসার জন্য সকলে সমবেত হন এবং সেইখানে ক্লাইব আমীরচাঁদকে জাল লোহিত সন্ধিপত্রের কথা প্রকাশ করিয়া বলেন। শুনিয়া, আমীরচাঁদ মূছিত হইয়া পড়েন। তাহার পর তাহার মস্তিষ্ক বিকৃত হওয়ায়, ক্লাইব তাহাকে তীর্থযাত্রার পরামর্শ প্রদান করিয়াছিলেন। যড়যন্ত্রে শেঠদিগের লাভালাভের কথা বিশেষ কিছু বুঝা যায় না।

 মীরজাফরের সিংহাসনে উপবেশন করার পর ইংরেজরা বাঙ্গলার একরূপ সর্বময় কর্তা হইয়া উঠিলেন। এই সময়ে তাঁহারা আপনাদিগের লাভালাভের বিষয়ে সবিশেষ মনোযোগী হইলেন। আপনাদের সুবিধার জন্য তাঁঁহারা ১৭৫৮ খ্রীঃ অব্দে কলিকাতায় একটি টাঁকশাল স্থাপন করিলেন। কলিকাতা টাঁকশালের মুদ্রিত মুদ্র প্রচলিত করিবার জন্য তাঁঁহারা যথেষ্ট চেষ্টা আরম্ভ করিয়াছিলেন; কিন্তু প্রথমে কৃতকার্য হইতে পারেন নাই। তখনও সমস্ত বঙ্গদেশে এবং বাদশাহের নিকট পর্যন্ত জগৎশেঠদিগের ক্ষমতা সমভাবেই বিরাজ করিতেছিল। কলিকাতায় টাঁকশাল হওয়ায় মুর্শিদাবাদ টাঁকশালের ক্ষতি হইতে আরম্ভ হয়; কাজেই জগৎশেঠদিগেরও লাভে বিঘ্ন উপস্থিত হইয়াছিল। কিন্তু সমস্ত বঙ্গদেশে মুদ্রাপ্রচলনের ভার জগৎশেঠের হস্তে থাকায়, প্রথম প্রথম কেহ মুর্শিদাবাদের মুদ্রিত টাকার পরিবর্তে কলিকাতার মুদ্রিত টাকা গ্রহণ করিতে

  1. Riyaz-us-salatin, p. 373.