পাতা:মৃণালিনী - বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/১৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
১৮৬
মৃণালিনী।

 পশুপতি উন্মত্তের ন্যায় আপন ভবনাভিমুখে ছুটিলেন। আপনার ভবনসম্মুখে উপস্থিত হইলেন। দেখিলেন, যাহা ভাবিয়াছিলেন তাহাই ঘটিয়াছে―জ্বলন্ত পর্ব্বতের ন্যায় তাঁহার উচ্চচূড় অট্টালিকা অগ্নিময় হইয়া জ্বলিতেছে।

 দৃষ্টিমাত্র হতভাগ্য পশুপতির প্রতীত হইল যে যবনেরা তাঁহার পৌরজনসহ মনোরমাকে বধ করিয়া গৃহে অগ্নি দিয়া গিয়াছে। মনোরমা যে পলায়ন করিয়াছিল, তাহা তিনি কিছু জানিতে পারেন নাই।

 নিকটে কেহই ছিল না যে তাঁহাকে এ সম্বাদ প্রদান করে। আপন বিকল চিত্তের সিদ্ধান্তই তিনি গ্রহণ করিলেন। হলাহল কলস পরিপূর্ণ হইল―হৃদয়ের শেষ তন্ত্রী ছিঁড়িল। তিনি কিয়ৎক্ষণ বিস্ফারিত নয়নে দহ্যমান অট্টালিকা প্রতি চাহিয়া রহিলেন―মরণোন্মুখ পতঙ্গবৎ অল্পক্ষণ বিচলশরীরে একস্থানে অবস্থিতি করিলেন―শেষে মহাবেগে সেই অনলতরঙ্গ মধ্যে ঝাঁপ দিলেন। সঙ্গের প্রহরী চমকিত হইয়া রহিল।

 মহাবেগে পশুপতি জ্বলন্ত দ্বারপথে পুরমধ্যে প্রবেশ করিলেন। চরণ দগ্ধ হইল―অঙ্গ দগ্ধ হইল―কিন্তু পশুপতি ফিরিলেন না। অগ্নিকুণ্ড অতিক্রম করিয়া আপন শয়নকক্ষে গমন করিলেন―কাহাকেও দেখিলেন না। দগ্ধ শরীরে কক্ষে কক্ষে ছুটিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। তাঁহার অন্তরমধ্যে যে দুরন্ত তাগ্নি জ্বলিতেছিল―তাহাতে তিনি বাহ্যিক দাহযন্ত্রণা অনুভূত করিতে পারিলেন না।

 ক্ষণে ক্ষণে গৃহের নূতন নূতন খণ্ড সকল অগ্নিকর্তৃক আক্রান্ত হইতেছিল। ক্ষণমধ্যে আক্রান্ত প্রকোষ্ঠ বিষম শিখা আকাশপথে উত্থিত করিয়া ভয়ঙ্কর গর্জ্জন করিতেছিল। ক্ষণে ক্ষণে দগ্ধ গৃহাংশ সকল অশণিসম্পাত শব্দে ভূতলে পড়িয়া যাইতেছিল।