ব্যক্তিগত নহে, এবং কবির যথার্থ জীবনও তাঁহার আপনার একলার জিনিস নহে। তিনি যেন সচ্ছিদ্র বংশখণ্ডের মতো, অন্য জিনিষে যে ছিদ্র কাজের পক্ষে ব্যাঘাতকর হয়, বংশখণ্ডে সেই ছিদ্রই বিশ্বসংগীত প্রচার করিয়া থাকে।
সেইজন্য আমি যখন বলিলাম যে রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক সাধনা কোনো বাহিরের সংস্কারকে অবলম্বন করে নাই, তাহা তাঁহার সমস্ত জীবনের ভিতর হইতে উদ্ভুত হইয়াছে, তখন এ কথা বুঝিতে হইবে যে, জীবনের সকল বিচিত্রতাকে পরিপূর্ণ একের মধ্যে পাইবার আকাঙ্ক্ষাই কবির পরিণত জীবনে কাজ করিতেছে। সুতরাং এই পরিণতিকে সকল বৈচিত্র্যের মধ্যে পড়িতে হইবে, নানা তানকে সমের মধ্যে মিলাইয়া পূর্ণ রাগিণীর সমগ্র রূপটিকে দেখিতে হইবে। সমগ্রকে তেমন করিয়া দেখা শক্ত। সমগ্র হর্ম্যের একটা ভাবগত চেহারা তাহার নির্মাতার মনের মধ্যে থাকে, হর্ম্যের প্রত্যেকটি অংশ তাই সেই ভাবগত সম্পূর্ণ চেহারাটির অন্তর্গত হইয়া গড়িয়া উঠে। সেই ভাবগত চেহারাটি দেখাই আসল দেখা— কত ইঁট বা কত প্রস্তর এবং কী পরিমাণ মজুরি দিয়া হর্ম্যটি নির্মিত হইয়াছে তাহার হিসাব রাখিয়া আনন্দ কি!
গীত-সংগতে যেমন নানা বাদ্যযন্ত্র বাজে, নানা সুরে— প্রত্যেকটিই তাহার চরম সংগীতকেই প্রকাশ করিবার জন্য ব্যস্ত— অথচ সেই সমস্তকে মিলাইয়া এক বিপুল একতান সংগীত শোনা যায়, ঠিক সেইরকম রবীন্দ্রনাথের জীবনে সমস্ত বিচিত্রতা প্রত্যেকে আপনার চরমতম সুরকে প্রকাশ করিয়াও পরম ঐক্যের রাগিণীর মধ্যেই আপনাকে বিসর্জন দিয়াছে। সেইজন্যই তাঁহার কাবের খণ্ডতার চেয়ে তাহার সমগ্রতার মূর্তিই বেশি করিয়া দেখিবার বিষয়।
১৭