রচনা বাহির হয়। ইহার কারণ সর্বাঙ্গীণ মানসোৎকর্ষের একটা ক্ষুধা পূর্বে এমন করিয়া জাগে নাই—দেশবিদেশের সকল প্রকার চেষ্টা ও চিন্তার প্রবাহের সঙ্গে নিজের যোগ রক্ষা করিবার কোনো তাগিদই কবির মনে পূর্বে ছিল না। সাধনার সময়কার রচনা বিচিত্র দিকে— সাময়িক ইংরেজি মাসিক পত্রিকা হইতে সারসংকলন, বৈজ্ঞানিক সংবাদ, রাজনীতির আলোচনা, সমাজতত্ত্ব— প্রতি মাসে মাসে গল্প ও কাব্য বাদে এই প্রকারের বিবিধ রচনা সাধনাতে প্রকাশিত হইত। যথার্থ ই সেটা একটা সাধনার কাল ছিল।
সমাজের ক্ষুদ্র আচারবিচার-লোকাচারের অন্ধ অনুবর্তিতাকে তখন সাধনায় কবি সুতীব্র আঘাত দিতেন। ‘সোনার তরী’ কাব্যের মধ্যেও তাহার কিছু কিছু চিহ্ন আছে। এবং রাজনীতিক্ষেত্রে কর্মের দায়িত্বহীন নাকী সুরের নালিশ, রাজদ্বারে “আবেদন এবং নিবেদনে”র লজ্জাকর হীনতাকেও কবি কম আঘাত করিতেন না।
অথচ এ সময়ের জীবনটি প্রকৃতির একটি অতি নিবিড় উপভোগের মধ্যে নিমগ্ন হইয়া ছিল। নৌকাবাসের জীবন— নদীতে নদীতে ভ্রমণ— কখনো জনশূন্য পদ্মার বালুচরে, কখনো গ্রামের ধারে বোট বাঁধিয়া থাকা। ‘ছোটোখাটো গ্রাম, ভাঙাচোরা ঘাট, টিনের ছাত-ওয়ালা বাজার, বাঁখারির-বেড়া-দেওয়া গোলাঘর, বাঁশঝাড়, আম কাঁঠাল খেজুর শিমুল কলা আকন্দ ভেরেণ্ডা ওল কচু লতাগুল্ম তৃণের সমষ্টিবদ্ধ ঝোপঝাড় জঙ্গল, ঘাটে-বাঁধা মাস্তুল-তোলা বৃহদাকার নৌকোর দল, নিমগ্নপ্রায় ধান’-এর পাশ দিয়া নৌকাযাত্রা— কি চমৎকার পরিপূর্ণ দিনগুলি তখনকার, তাহা কেবল কবিতা হইতে নহে, তাঁহার গল্পগুচ্ছ এবং সেই বয়সের অনেকগুলি চিঠি হইতে বেশ বুঝিতে পারি। বস্তুত অধিকাংশ গল্পই প্রকৃতির এক-একটি অনুভাবকে প্রকাশ করিবার আবেগেই লিখিত।
৪৪