পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

test ७१३) হেমাঙ্গিনী বিদায় লইলে আমার পৃথিবীটা শুষ্ক হইয়া গেল- সে আমার প্রাণের মধ্যে যে সৌগন্ধ্য সৌন্দৰ্য সংগীত যে উজ্জ্বল আলো এবং যে কোমল তরুণতা আনিয়াছিল তাহা চলিয়া গেলে একবার আমার সমস্ত সংসার, আমার চারি দিকে, দুই হাত বাড়াইয়া দেখিলাম, কোথায় আমার কী আছে ! আমার স্বামী আসিয়া বিশেষ প্ৰফুল্লতা দেখাইয়া কহিলেন, “ইহারা গেলেন, এখন বঁাচা গেল, একটু কাজকর্ম করিবার অবসর পাওয়া যাইবে।” ধিক ধিক, আমাকে । আমার জন্য কেন এত চাতুরী । আমি কি সত্যকে ডরাই । আমি কি আঘাতকে কখনো ভয় করিয়াছি । আমার স্বামী কি জানেন না ? যখন আমি দুই চক্ষু দিয়াছিলাম তখন আমি কি শান্তমনে আমার চিরান্ধকার গ্রহণ করি নাই ? এতদিন আমার এবং আমার স্বামীর মধ্যে কেবল অন্ধতার অন্তরাল ছিল, আজ হইতে আর-একটা ব্যবধান সৃজন হইল। আমার স্বামী ভুলিয়াও কখনো হেমাঙ্গিনীর নাম আমার কাছে উচ্চারণ করিতেন না, যেন তাহার সম্পর্কীয় সংসার হইতে হেমাঙ্গিনী একেবারে লুপ্ত হইয়া গেছে, যেন সেখানে সে কোনোকালে লেশমাত্র রেখাপাত করে নাই । অথচ পত্র দ্বারা তিনি যে সর্বদাই তাহার খবর পাইতেছেন, তাহা আমি অনায়াসে অনুভব করিতে পারিতাম ; যেমন পুকুরের মধ্যে বন্যার জল যেদিন একটু প্ৰবেশ করে সেই দিনই পদ্মের উাটায় টান পড়ে, তেমনি তাহার ভিতরে একটুও যেদিন স্ফীতির সঞ্চার হয় সেদিন আমার হৃদয়ের মূলের মধ্য হইতে আমি আপনি অনুভব করিতে পারি। কবে তিনি খবর পাইতেন এবং কবে পাইতেন না। তাহা আমার কাছে কিছু অগোচর ছিল না । কিন্তু, আমিও তাহাকে তাহার কথা শুধাইতে পারিতাম না । আমার অন্ধকার হৃদয়ে সেই যে উন্মত্ত উদাম উজ্জ্বল সুন্দর তারাটি ক্ষণকালের জন্য উদয় হইয়াছিল তাহার একটু খবর পাইবার এবং তাহার কথা আলোচনা করিবার জন্য আমার প্রাণ তুধিত হইয়া থাকিত, কিন্তু আমার স্বামীর কাছে মুহুর্তের জন্য তাহার নাম করিবার অধিকার ছিল না। আমাদের দুজনার মাঝখানে বাক্যে এবং বেদনায় পরিপূর্ণ এই একটা নীরবতা অটল ভাবে বিরাজ করিত । বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি একদিন বি আসিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, “মােঠাকরুন, ঘাটে যে অনেক আয়োজনে নৌকা প্ৰস্তুত হইতেছে, বাবামশায় কোথায় যাইতেছেন ?” আমি জানিতাম, একটা কী উদ্যোগ হইতেছে ; আমার অদৃষ্টাকাশে প্রথম কিছুদিন ঝড়ের পূর্বকার নিন্তৰুতা এবং তাহার পরে প্ৰলয়ের ছিন্নবিচ্ছিন্ন মেঘ আসিয়া জমিতেছিল, সংহারকারী শংকর নীরব অঙ্গুলির ইঙ্গিতে তাহার সমস্ত প্ৰলয় শক্তিকে আমার মাথার উপরে জড়ো করিতেছেন, তাহা আমি বুঝিতে পারিতেছিলাম। কিকে বলিলাম, “কই, আমি তো এখনো কোনো খবর পাই নাই ।” কি আর-কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে সাহস না করিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া চলিয়া গেল । অনেক রাত্রে আমার স্বামী আসিয়া কহিলেন, “দুরে এক জায়গায় আমার ডাক পড়িয়ছে, কাল ভোরেই আমাকে রওনা হইতে হইবে । বোধ করি ফিরিতে দিন-দুই-তিন বিলম্ব হইতে পারে।” আমি শয্যা হইতে উঠিয়া দাড়াইয়া কহিলাম, “কেন আমাকে মিথ্যা বলিতেছে।” আমার স্বামী কম্পিত অস্ফুট কণ্ঠে কহিলেন, “মিথ্যা কী বলিলাম।” আমি কহিলাম “তুমি বিবাহ করিতে যাইতেছ!” তিনি চুপ করিয়া রহিলেন । আমিও স্থির হইয়া দাড়াইয়া রহিলাম। অনেকক্ষণ ঘরে কোনাে শব্দ রহিল না । শেষে আমি বলিলাম, “একটা উত্তর দাও । বলো, ই, আমি বিবাহ করিতে যাইতেছি।” তিনি প্ৰতিধ্বনির ন্যায় উত্তর দিলেন, “ই, আমি বিবাহ করিতে যাইতেছি ।” । আমি কহিলাম, “না, তুমি যাইতে পরিবে না। তোমাকে আমি এই মহাবিপদ মহাপাপ হইতে রক্ষা করিব। এ যদি না পারি। তবে আমি তোমার কিসের শ্ৰী ; কী জন্য আমি শিবপূজা করিয়াছিলাম।” আবার অনেকক্ষণ গৃহ নিঃশব্দ হইয়া রহিল। আমি মাটিতে পড়িয়া স্বামীর পা জড়াইয়া ধরিয়া কহিলাম, “আমি তোমার কী অপরাধ করিয়াছি, কিসে আমার ত্রুটি হইয়াছে, অন্য বীতে তোমার কিসের প্রয়োজন । মাথা খাও, সত্য করিয়া বলে ।” তখন আমার স্বামী ধীরে ধীরে কহিলেন, “সত্যই বলিতেছি, আমি তোমাকে ভয় করি । তোমার