পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (একাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(?8S মর্যাদার আদর্শ সকল রাজরানীর মধ্যে এক । ওটা প্রকৃতির হাতে তৈরি নয়, রাজসমাজের দ্বারা নির্দিষ্ট । অর্থাৎ, ওটা প্ৰাকৃত নয়, সংস্কৃত । তাই দুৰ্য্যন্ত স্বীকার করেছিলেন বটে। বনলতার দ্বারা উদ্যােনলতা পরাভূত, তবু উদ্যানকে বনের আদর্শে রমণীয় করে তুলতে নিশ্চয় তার সাহস হয় নি । তাই, আমি নিজে আকন্দযুকূল ভালোবাসি, কিন্তু আমার সাধুসমাজের মালি ঐ গাছের অন্ধুর দেখবামাত্র উপড়ে ফেলে। সে যদি কবি হত, সাধুভাষায় ছাড়া কবিতা লিখিত না । সাধুভাষার ছন্দের বাধারীতি যে-জাতীয় ছন্দে চলে এবং শোভা পায় সে হচ্ছে পয়ারজাতীয় ছন্দ। এখানে ফাঁক-ফোক নির্দিষ্ট আসনের উপর 'নানা ওজনেরই ধ্বনিকে চড়ানো নিরাপদ । এখানে ঠিক চোদটা অক্ষরকে বাহন করে যুগ-অযুগ নানারকমের ধ্বনিই একত্র সভা জমাতে পারে। কাব্যলীলা একদিন যখন শুরু করেছিলেম। তখন বাংলাসাহিত্যে সাধুভাষারই ছিল একাধিপত্য । অর্থাৎ তখন ছিল কাটা-কাটা পিডিতে ভাগ-করা ছন্দ । এই আইনের অধীনে যতক্ষণ পয়ারের এলাকায় থাকি ততক্ষণ আসনপীড়া ঘটে না । কিন্তু, তিনমাত্রা মূলক ছন্দের দিকে আমার কলমের একটা স্বাভাবিক ঝোক ছিল । ঐ ছন্দে প্ৰত্যেক অক্ষরে স্বতন্ত্ৰ-আরূঢ় সকল ওজনেরই ধ্বনিকেই সমান দরের একক বলে ধরে নিতে বারংবার কানে বাজত। সেইজনে যুক্ত-অক্ষর অর্থাৎ যুগ্মধ্বনি বর্জন করবার একটা দুর্বল আভাস আমাকে ক্রমেই পেয়ে বসছিল । ঠোকর খাবার ভয়ে পদগুলোকে একেবারে সমতল করে যাচ্ছিলুম। সব জায়গায় পেরে উঠি নি, কিন্তু মোটের উপর চেষ্টা ছিল । ছবি ও গান'-এ 'বাহুব প্ৰেম কবিতা পড়লে দেখা যাবে যুক্ত-অক্ষর বেঁটিয়ে দেবার প্রয়াস আছে। তবু তারা পাথরের টুকবোব মতো রাস্তার মাঝে মাঝে উচু হয়ে রইল। তাই যখন লিখেছিলুম কঠিন বাধনে চরণ বেড়িয়া চিরকাল তোরে রব আঁকিডিয়া 蛙 W g Qtik .ب মনে খটকা লেগেছিল, কান প্ৰসন্ন হয় নি । কিন্তু তখন কলম ছিল অপটু এবং অলস মন ছিল অসতর্ক । কেননা, পাঠকদেব তরফ থেকে বিপদের আশঙ্কা ছিল না । তখন ছন্দের সদর রাস্তাও গ্ৰাম্য বাস্তার মতো এবডো- খেবড়ো থাকত, অভাসের গতিকে কেউ সেটাকে নিন্দনীয় বলে মনেও করে ਜਿ অক্ষরের দাসতে বন্দী বলে প্ৰবোধচন্দ্র বাঙালি কবিদেরকে যে দোষ দিয়েছেন সেটা এই সময়কার পক্ষে কিছু অংশে খাটে । অর্থাৎ অক্ষরের মাপ সমান রেখে ধ্বনির মাপে ইতারবিশেষ করা তখনকার শৈথিল্যের দিনে চলত এখন চলে না । তখন পয়ারের রীতি সকল ছন্দেরই সাধারণ রীতি বলে সাহিতাসমাজে চলে গিযেছিল । তার প্রধান কারণ পয়ারজাতীয় ছন্দই তখন প্রধান, অন্যজাতীয় অর্থাৎ ত্রৈমাত্ৰিক ছন্দের ব্যবহার তখন অতি অল্পই । তাই এই মাইনরিটির স্বতন্ত্র দাবি সেদিন বিধিবদ্ধ হয় fo ; তার পরে ‘মানসী" লেখার সময় এল । তখন ছন্দের কান আর ধৈর্য রাখতে পারছে না । এ কথা তখন নিশ্চিত বুঝেছি যে, ছন্দের প্রধান সম্পদ যুগ্মধ্বনি ; অথচ এটাও জানছি যে, পয়ারসম্প্রদায়ের বাইরে নির্বিচারে যুগ্মধ্বনির পরিবেশন চলে না । রয়েছে পডিয়া শৃঙ্খলে বাধা এ লাইন-বেচারাকে পয়ারের বাধাপ্রথাটা শৃঙ্খল হয়েই বেঁধেছে, তিন মাত্রার স্কন্ধকে চার মাত্রার বোঝা বইতে হচ্ছে । সেই 'মানসী" লেখবার বয়সে আমি যুষ্মধ্বনিকে দুই মাত্রার মূল্য দিয়ে ছন্দরচনায় প্রবৃত্ত হয়েছি । প্রথম প্রথম পয়ারেও সেই নিয়ম প্রয়োগ করেছিলুম। অনতিকাল পরেই দেখা গেল, তার প্রয়োজন নেই । পয়ারে যুগ্মধ্বনির উপযুক্ত ফাক যথেষ্ট আছে । (এই প্ৰবন্ধে আমি ত্রিপদী প্রভৃতি পয়ার জাতীয় সমস্ত দ্বৈমাত্ৰিক ছন্দকেই ‘পয়াব' নাম দিচ্ছি।)