পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৫২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চোখের বালি (to\లీ আত্মসমর্পণ করিয়াছিল। আজ বিনোদিনীকে সম্মুখে দেখিয় তাহার খণ্ডিত প্রেমের দাহ শাস্তি মানিল না । ইহাকে মহেন্দ্র একদিন ভালোবাসিয়াছিল, ইহাকে এখনো হয়তো মনে মনে ভালোবাসে– এ-কথা তাহার বুকের ভিতরে ঢেউয়ের মতো ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরেই মহেন্দ্র জাগিয়া উঠিবে, বিনোদিনীকে দেখিবে— কী জানি কী চক্ষে দেখিবে ! কাল রাত্রে আশা তাহার সমস্ত সংসারকে নিষ্কণ্টক দেখিয়াছিল— আজ প্রত্যুষে উঠিয়াই দেখিল, কাটাগাছ তাহার ঘরের প্রাঙ্গণেই । সংসারে মুখের স্থানই সব চেয়ে সংকীর্ণ—কোথাও তাহাকে সম্পূর্ণ নির্বিয়ে রাখিবার অবকাশ নাই । হৃদয়ের ভার লইয়া আশা রাজলক্ষ্মীর ঘরে প্রবেশ করিল, এবং অত্যন্ত লজ্জার সঙ্গে কহিল, “মাসিম, তুমি সমস্ত রাত বসিয়া আছ— যাও, শুতে যাও!” অন্নপূর্ণ আশার মুখের দিকে একবার ভালো করিয়া চাহিয়া দেখিলেন। তাহার পরে শুইতে না গিয়া আশাকে নিজের ঘরে লইয়া গেলেন। কহিলেন, "চুনি, যদি সুখী হইতে চাস, তবে সব কথা মনে রাথিসনে। অন্তকে দোষী করিয়া যেটুকু স্থখ, দোষ মনে রাখিবার দুঃখ তাহার চেয়ে ঢের বেশি।” আশা কহিল, "মাসিম, আমি মনে কিছু পুষিয়া রাথিতে চাই না, আমি ভুলিতেই চাই, কিন্তু ভুলিতে দেয় না যে ।” অন্নপূর্ণ। বাছা, তুই ঠিক বলিয়াছিস— উপদেশ দেওয়া সহজ, উপায় বলিয়৷ দেওয়াই শক্ত। তবু আমি তোকে একটা উপায় বলিয়া দিতেছি। যেন ভুলিয়াছিল এই ভাবটি অন্তত বাহিরে প্রাণপণে রক্ষা করিতে হইবে— আগে বাহিরে ভুলিতে আরম্ভ করিস, তাহা হইলে ভিতরেও ভুলিবি। এ-কথা মনে রাখিস চুনি, তুই যদি না ভুলিস, তবে অন্যকেও স্মরণ করাইয়া রাখিবি ! তুই নিজের ইচ্ছায় না পারিস, আমি তোকে আজ্ঞা করিতেছি, তুই বিনোদিনীর সঙ্গে এমন ব্যবহার কর, যেন সে কখনো তোর কোনো অনিষ্ট করে নাই এবং তাহার দ্বারা তোর অনিষ্টের কোনো আশঙ্কা নাই । আশা নম্ৰমুখে কহিল, "কী করিতে হইবে, বলে ।” অন্নপূর্ণ কছিলেন, “বিনোদিনী এখন বিহারীর জন্তে চা তৈরি করিতেছে। তুই দুধ-চিনি-পেয়ালা সমস্ত লইয়া যা— দুই জনে মিলিয়া কাজ কর।” । আশা আদেশপালনের জন্য উঠিল । অন্নপূর্ণ কহিলেন, “এটা সহজ—কিন্তু আমার আর-একটি কথা আছে, সেটা আরো শক্ত— সেইটে তোকে পালন করিতেই হইবে । মাঝে মাঝে মহেঞ্জের সঙ্গে বিনোদিনীর দেখা হইবেই, তখন তোর মনে কী হইবে,