পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৫২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

q Sq V রবীন্দ্র-রচনাবলী > ひ বিদ্যালয়ের দুটি নিকটবর্তী। ছুটির সময়ে কমলাকে বিদ্যালয়েই রাখিবার জন্য রমেশ কষ্ট্রীর সঠিা পূর্বেই ঠিক করিয়াছিল। রমেশ প্রত্যুষে উঠিয়া ময়দানের নির্জন রাস্তায় পদচারণা করিতে করিতে স্থির করিল, বিবাহের প) সে কমলা সম্বন্ধে হেমনলিনীকে সমস্ত ঘটনা আগাগোড়া বিস্তারিত করিয়া বলিবে । তাহার প? কমলাকেও সমস্ত কথা বলিবার অবকাশ হইবে । এইরূপ সকল পক্ষে বোঝাপড়া হইয়া গেলে কমল স্বচ্ছন্দে বন্ধুভাবে হেমনলিনীর সঙ্গেই বাস করিতে পরিবে । দেশে ইহা লইয়া নানা কথা উঠতে পাে? ইহাই মনে করিয়া সে হাজারিবাগে গিয়া প্র্যাকটিস করিবে স্থির করিয়াছে। ময়দান হইতে ফিরিয়া আসিয়া রমেশ অন্নদাবাবুর বাড়ি গেল। সিঁড়িতে হঠাৎ হেমনলিনীর স? দেখা হইল অন্যদিন হইলে এরূপ সাক্ষাতে একটু কিছু আলাপ হইত। আজ হেমনলিনীর মুখ লাল । হইয়া উঠিল, সেই রক্তিমার মধ্য দিয়া একটা হাসির আভা উষার আলোকের মতো দীপ্তি পাইলহেমনলিনী মুখ ফিরাইয়া চোখ নিচু করিয়া দ্রুতবেগে চলিয়া গৈল । রমেশ যে গৎটা হেমনলিনীর কােছ হইতে হারমেনিয়মে শিখিয়াছিল, বাসায় গিয়া সেইটে খু? করিয়া বাজাইতে লাগিল। কিন্তু একটিমাত্র গৎ সমস্ত দিন বাজানো চলে না । কবিতার বই পড়িয়ে চেষ্টা করিল--- মনে হইল, তাহার ভালোবাসার সুর যে সুদূর উচ্চে উঠিতেছে কোনো কবিতা সে পর্যন্ত্র নাগাল পাইতেছে না | আর হেমনলিনী অশ্রান্ত আনন্দের সহিত তাহার গৃহকর্ম সমস্ত সারিয়া নিভৃত দ্বিপ্রহরে শয়নঘরে ? দ্বার বন্ধ করিয়া তাহার সেলাইটি লইয়া বসিয়াছে । মুখের উপরে একটি পরিপূর্ণ প্ৰসন্নতার শান্তি একটি সর্বাঙ্গাণ সার্থকতা তাহাকে বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে । চায়ের সময়ের পূর্বেই কবিতার বই এবং হারমেনিয়ম ফেলিয়া রমেশ অন্নদাবাবুর বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইল । অনাদিন হেমনলিনীর সহিত দেখা হইতে বড়ো বিলম্ব হইত না । কিন্তু আজ চায়ে? ঘরে দেখিল সে ঘর শূনা, দোতলায় বসিবার ঘরে দেখিল সে ঘরও শূন্য, হেমনলিনী এখনো তাহার শয়নগহ ছাডিয়া নামে নাই । অন্নদাবাবু যথাসময়ে আসিয়া টেবিল অধিকার করিয়া বসিলেন । রমেশ ক্ষণে ক্ষণে চকিতভাবে দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল । পদশব্দ হইল, কিন্তু ঘরে প্রবেশ করিলা অক্ষয় । যথেষ্ট হৃদ্যতা দেখাইয়া কহিল, “এই-যে, রমেশবাবু, । আমি আপনার বাসাতেই গিয়াছিলাম।” শুনিয়াই রমেশের মুখে উদবেগের ছায়া পড়িল । অক্ষয় হাসিয়া কহিল, “ভয় কিসের রমেশবাবু ? আপনাকে আক্রমণ করিতে যাই নাই । শুভসংবাদে অভিনন্দন প্রকাশ করা বন্ধুবান্ধবের কর্তব্য — তাহাই পালন করিতে গিয়াছিলাম।” এই কথায় অন্নদাবাবুর মনে পড়িল হেমনলিনী উপস্থিত নাই। হেমনলিনীকে ডাক দিলেন- উত্তর না পাইয়া তিনি নিজে উপরে গিয়া কহিলেন, “ হেম, এ কী, এখনো সেলাই লইয়া বসিয়া আছ ! চা তৈরি যে বমেশ-অক্ষয় আসিয়াছে ।” হেমনলিনী মুখ ঈষৎ লাল কবিয়া কহিল, “বাবা, আমার চা উপরে পাঠাইয়া দাও, আজ আমি সেলাইট শেষ করিতে চাই ।” অন্নদা ঐ তোমার দোষ হেম । যখন যেটা লইয়া পড়, তখন আর-কিছুই খেয়াল কর না ; যখন পড়া লইয়া ছিলে তখন বই কোল হইতে নামিত না- এখন সেলাই লইয়া পড়িয়াছ, এখন আব-সমস্তই বন্ধ না না, সে হইবে না- চলো, নীচে গিয়া চা খাইবে চলো । এই বলিয়া অন্নদাবাবু জোর করিয়াই হেমনলিনীকে নীচে লইয়া আসিলেন । সে আসিয়াই কাহারও দিকে দৃষ্টি না করিয়া তাড়াতাডি চা ঢালিবার ব্যাপারে ভারি বাস্ত হইয়া উঠিল ।