পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৫৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নৌকাডবি A AQ অন্নদাবাবু অধীর হইয়া কহিলেন, “হেম, ও কী করিতেছ ? আমার পেয়ালায় চিনি দিতেছ। কেন ? আমি তো কোনোকালেই চিনি দিয়া চা খাই না ।” অক্ষয় টিপিটপি হাসিয়া কহিল, “আজ উনি ঔদার্য সংবরণ করিতে পারিতেছেন না- আজি সকলকেই মিষ্ট বিতরণ করবেন ।” হেমনলিনীর প্রতি এই প্রচ্ছন্ন বিদ্রুপ রমেশের মনে মনে অসহ্য হইল। সে তৎক্ষণাৎ স্থির করিল, আর যাই হউক, বিবাহের পরে অক্ষয়ের সহিত কোনো সম্পর্ক রাখা হইবে না । অক্ষয় কহিল, “রমেশবাবু, আপনার নামটা বদলাইয়া ফেলুন।" রমেশ এই রসিকতার চেষ্টায় অধিকতর বিরক্ত হইয়া কহিল, “কোন বলুন দেখি ।” অক্ষয় খবরের কাগজ খুলিয়া কহিল, “এই দেখুন, আপনার নামের একজন ছাত্র অন্য লোককে নিজের নামে চালাইয়া পরীক্ষা দেওয়াইয়া পাস হইয়াছিল— হঠাৎ ধরা পডিয়াছে।” হেমনলিনী জানে, রমেশ মুখের উপর উত্তর দিতে পারে না--- সেইজন্য এতকাল অক্ষয় রমেশকে যত আঘাত করিয়াছে সে-ই তাহার প্রতিঘাত দিয়া আসিয়াছে । আজও থাকিতে পারিল না । গৃঢ় ক্ৰোধের লক্ষণ চাপিয়া ঈষৎ হাসা করিয়া কহিল, “অক্ষয় বলিয়া ঢের লোক বোধ হয় জেলখানায় অক্ষয় কহিল, “ঐ দেখুন, বন্ধুভাবে সৎপরামর্শ দিতে গেলে আপনারা রাগ করেন । তবে সমস্ত ইতিহাসটা বলি । আপনি তো জানেন, আমার ছোটাে বোন শরৎ বালিকা বিদ্যালয়ে পড়িতে যায় । সে কাল সন্ধার সময় আসিয়া কহিল, "দাদা, তোমাদের রমেশবাবুর স্ত্রী আমাদের ইস্কুলে পড়েন । আমি বলিলাম, “দূর পাগলী ! আমাদের রমেশবাবু ছাড়া কি আর দ্বিতীয় রমেশবাবু জগতে নাই ? শরৎ কহিল, “তা যেই হোন, তিনি তার স্ত্রীর উপরে ভারি অন্যায় কবিতেছেন ; ছুটিতে প্রায় সব মেয়েই বাড়ি যাইতেছে, তিনি তার স্ত্রীকে বোর্ডিঙে রাখিবার বন্দোবস্ত করিয়াছেন । সে বেচারা কাদিয়া কাটিয়া অনৰ্থপতি করিতেছে । আমি তখনই মনে মনে কহিলাম, এ তো ভালো কথা নহে, শরৎ, যেমন ভুল করিয়াছিল, এমন ভুল আরো তো কেহ কেহ করিতে পারে ” অন্নদাবাবু হাসিয়া উঠিয়া কহিলেন, “অক্ষয়, তুমি কী পাগলের মতো কথা কহিতেছ! কোন এমন সময়ে হঠাৎ বিবর্ণমুখে রমেশ ঘর হইতে উঠিয়া চলিয়া গেল। অক্ষয় বলিয়া উঠিল, “ও কী রমেশবাবু, আপনি রাগ করিয়া চলিয়া গেলেন নাকি ? দেখুন দেখি, আপনি কি মনে করেন। আপনাকে আমি সন্দেহ করিতেছি ?” বলিয়া রমেশের পশ্চাৎ পশ্চাৎ বাহির হইয়া গেল । অন্নদাবাবু কহিলেন, “এ কী কাণ্ড !" হেমনলিনী কঁাদিয়া ফেলিল। অন্নদাবাবু ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “ও কী হেম, কঁাদিস কেন ?” সে উচ্ছসিত রোদনের মধ্যে রুদ্ধকণ্ঠে কহিল, “বাবা, অক্ষয়বাবুর ভারি অনায় । কেন উনি আমাদের বাড়িতে ভদ্রলোককে এমন করিয়া অপমান করেন ?” অন্নদাবাবু কহিলেন, “অক্ষয় ঠাট্টা করিয়া একটা কী বলিয়ছে, ইহাতে এত অস্থির হইবার কী দরকার ছিল ?” “এ-রকম ঠাট্টা অসহ্য ।” বলিয়া দ্রুতপদে হেমনলিনী উপরে চলিয়া গেল । এইবার কলিকাতায় আসার পর রমেশ বিশেষ যত্নের সহিত কমলার স্বামীর সন্ধান করিতেছিল । বহুকষ্টে ধোবাপুকুরটা কোন জায়গায়, তাহা বাহির করিয়া কমলার মামা তারিণীচরণকে এক পত্র লিখিয়াছিল । উক্ত ঘটনার পরদিন প্রাতে রমেশ সেই পত্রের জবাব পাইল । তারিণীচরণ লিখিতেছেন, দুর্ঘটনার পরে তাহার জামাতা শ্ৰীমান নলিনাক্ষের কোনো সংবাদই পাওয়া যায় নাই । রংপুরে তিনি ডাক্তারি করিতেন- সেখানে চিঠি লিখিয়া তারিণীচরণ জানিয়াছেন, সেখানেও কেহ আজ পর্যন্ত তাহার কোনো খবর পায় নাই । তাহার জন্মস্থান কোথায়, তাহা তারিণীচরণের জানা নাই ।