পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৭৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

(भोकाङ्कृति Q8 যোগেন্দ্রের সমস্ত সন্দেহ নিশ্চিত বিশ্বাসে পরিণত হইল। যোগেন্দ্ৰ কহিল, “কিন্তু অক্ষয়, এ-সমস্ত যুক্তি কোনো কাজেই লাগিবে না। শুধু হেমনলিনী কেন, বাবা-সুদ্ধ ঐ এক বুলি ধরিয়াছেন— তিনি বলেন, রমেশের নিজের মুখে শেষ কথা না শুনিয়া তিনি রমেশকে অবিশ্বাস করিতে পরিবেন না। এমন-কি, রমেশ আজও আসিয়া যদি বলে “আমি এখন কিছুই বলিব না, তবু নিশ্চয় বাবা তাহার সঙ্গে হেমের বিবাহ দিতে কুষ্ঠিত হন না। ইহাদের লইয়৷ আমি এমনি মুশকিলে পড়িয়ছি। বাবা হেমনলিনীর কিছুমাত্র কষ্ট সহ্য করিতে পারেন না ; হেম যদি আজ আবদার করিয়া বসে ‘রমেশের অন্য স্ত্রী থােক- আমি তাহাকেই বিবাহ করিব, তবে বাবা বোধ হয় তাহতেই রাজি হন। যেমন করিয়া হউক এবং যত শীঘ্ৰ হউক, রমেশকে দিয়া কবুল করাইতেই হইবে । তোমার হতাশ হইলে চলিবে না । আমিই এ কাজে লাগিতে পারিতাম, কিন্তু কোনোপ্রকার ফন্দি আমার মাথায় আসে না, আমি হয়তো। রমেশের সঙ্গে একটা মারামারি বাধাইয়া দিব । এখনো বুঝি তোমার মুখ-ধোওয়া চা-খাওয়া হয় নাই ?” অক্ষয় মুখ ধুইয়া চা খাইতে খাইতে ভাবিতে লাগিল। এমন সময়ে অন্নদাবাবু হেমনলিনীর হাত ধরিয়া চা খাইবার ঘরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন । অক্ষয়কে দেখিবামাত্র হেমনলিনী ফিরিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল । যোগেন্দ্র রাগ করিয়া কহিল, “হেমের এ ভারি অন্যায়। বাবা, তুমি উহার এই সকল অভদ্রতায় প্রশ্রয় দিয়ে না। উহাকে জোর করিয়া এখানে আনা উচিত । হেম ! হেম !” হেমনলিনী তখন উপরে চলিয়া গেছে। অক্ষয় কহিল, “যোগেন, তুমি আমার কেস আরো খারাপ করিয়া দিবে দেখিতেছি। উহার কাছে আমার সম্বন্ধে কোনো কথাটি কহিয়ে না। সময়ে ইহার প্ৰতিকার হইবে, জবরদস্তি করিতে গেলে সব মাটি হইয়া যাইবে।” এই বলিয়া অক্ষয় চা খাইয়া চলিয়া গেল । অক্ষয়ের ধৈর্যের অভাব ছিল না । যখন সমন্ত লক্ষণ তাহার প্রতিকূলে তখনাে সে লাগিয়া থাকিতে জানে। তাহার ভাবেরও কোনো বিকার হয় না। অভিমান করিয়া সে মুখ গভীর করে না বা দূরে চলিয়া যায় না। অনাদর-অবমাননায় সে অবিচলিত থাকে । লোকটা ট্যাকসই । তাহার প্রতি যাহার ব্যবহার যেমনি হউক, সে টিকিয়া থাকে । অক্ষয় চলিয়া গেলে আবার অন্নদাবাবু হেমনলিনীকে ধরিয়া চায়ের টেবিলে উপস্থিত করিলেন । আজ তাহার কপোল পাণ্ডুবৰ্ণ, তাহার চোখের নীচে কালি পড়িয়া গেছে। ঘরে ঢুকিয়া সে চোখ নিচু করিল, যোগেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিতে পারিল না। সে জানিত, যোগেন্দ্র তাহার ও রমেশের উপর রাগ করিয়াছে, তাহদের বিরুদ্ধে কঠিন বিচার করিতেছে । এইজন্য যোগেন্দ্রের সঙ্গে মুখোমুখি-চোখোচে্যুখি হওয়া তাহার পক্ষে দুরূহ হইয়া উঠিয়াছে। ভালোবাসায় যদিও হেমনলিনীর বিশ্বাসকে আগলাইয়া রাখিয়াছিল, তবু যুক্তিকে একেবারেই ঠেকাইয়া রাখা চলে না। যোগেন্দ্রের সম্মুখে হেমনলিনী কাল আপনার বিশ্বাসের দৃঢ়তা দেখাইয়া চলিয়া গেল। কিন্তু রাত্রের অন্ধকারে শয়নঘরের মধ্যে একলা সেই বল সম্পূর্ণ থাকে না । বস্তুতই প্রথম হইতেই রমেশের ব্যবহারের কোনো অর্থ পাওয়া যায় না। সন্দেহের কারণগুলিকে হেমনলিনী যত প্রাণপণ বলে তাহার বিশ্বাসের দুর্গের মধ্যে ঢুকিতে দেয় না— তাহারা বাহিরে দাড়াইয়া ততই সবলে আঘাত করিতে থাকে। সাংঘাতিক আঘাত হইতে মা যেমন ছেলেকে বুকের মধ্যে দুই হাতে চাপিয়া ধরিয়া রক্ষা করে, রমেশের প্রতি বিশ্বাসকে হেমনলিনী সমস্ত প্রমাণের বিরুদ্ধে তেমনি জোর করিয়া হৃদয়ে আঁকড়িয়া রাখিল। কিন্তু হয়, জোর কি সকল সময় সমান থাকে ? হেমনলিনীর পাশের ঘরেই রাত্রে অন্নদাবাবু শুইয়াছিলেন। হেম যে বিছানায় এপাশি-ওপাশ করিতেছিল, তাহা তিনি বুঝিতে পারিতেছিলেন। এক-এক বার তাহার ঘরে গিয়া তাহাকে বলিতেছিলেন, “মা, তোমার ঘুম হইতেছে না ?” হেমনলিনী উত্তর দিতেছিল, “বাবা, তুমি কেন জাগিয়া আছ ? আমার ঘুম আসিতেছে, আমি এখনই ঘুমাইয়া পড়িব ।” পরের দিন ভোরে উঠিয়া হেমনলিনী ছাদের উপর বেড়াইতেছিল। রমেশের বাসার একটি দরজা