পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা · 8ᏬᎸ . ললিতা সহজে কঁদিতে জানে না, কিন্তু আজ তাহার চোখ দিয়া জল যেন ফাটিয়া বাহির হইতে হিল। কী হইয়াছে ? কেন সে বিনয়বাবুকে বার বার এমন করিয়া খোচা দিতেছে এবং নিজে ব্যথা পাইতেছে ? বিনয় যতক্ষণ অভিনয়ে যোগ দিতে নারাজ ছিল ললিতার জেদও ততক্ষণ কেবলই চড়িয়া উঠিতেছিল, কিন্তু যখনই সে রাজি হইল তখনই তাহার সমস্ত উৎসাহ চলিয়া গেল । যোগ না-দিবার পক্ষে যতগুলি তর্ক, সমস্ত তাহার মনে প্রবল হইয়া উঠিল। তখন তাহার মন পীড়িত হইয়া বলিতে । লাগিল, “কেবল আমার অনুরোধ রাখিবার জন্য বিনয়বাবুর এমন করিয়া রাজি হওয়া উচিত হয় নাই। অনুরোধ ! কেন অনুরোধ রাখিবেন ? তিনি মনে করেন, অনুরোধ রাখিয়া তিনি আমার সঙ্গে ভদ্রতা করিতেছেন। তাহার এই ভদ্রতাটুকু পাইবার জন্য আমার যেন অত্যন্ত মাথাব্যথা !" কিন্তু এখন অমন করিয়া স্পর্ধা করিলে চলিবে কেন ? সত্যই যে সে বিনয়কে অভিনয়ের দলে টানিবার জন্য ক্রমাগত নির্বন্ধ প্রকাশ করিয়াছে। বিনয় ভদ্রতার দায়ে তাহার এত জেদের অনুরোধ রাখিয়াছে বলিয়া রাগ করিলেই বা চলিবে কেন ? এই ঘটনায় ললিতার নিজের উপরে এমনই তীব্র ঘূণা ও লজ্জা উপস্থিত হইল যে স্বভাবত এতটা হইবার কোনো কারণ ছিল না। অন্যদিন হইলে তাহার মনের চাঞ্চল্যের সময় সে সুচরিতার কাছে। যাইত। আজ গেল না এবং কেন যে তাহার বুকটাকে ঠেলিয়া তুলিয়া তাহার চােখ দিয়া এমন করিয়া জল বাহির হইতে লাগিল তাহা সে নিজেই ভালো করিয়া বুঝিতে পারিল না। i. পরদিন সকালে সুধীর লাবণ্যকে একটি তোড়া আনিয়া দিয়াছিল। সেই তোড়ায় একটি বেঁটায় দুইটি বিকচােমুখ বসোরা-গোলাপ ছিল। ললিতা সেটি তোড়া হইতে খুলিয়া লইল । লাবণ্য কহিল, “ও কী করছিস ?” ললিত কহিল, “তোড়ায় অনেকগুলো বাজে ফুল-পাতার মধ্যে ভালো ফুলকে বাধা দেখলে আমার কষ্ট হয়, ওরকম দড়ি দিয়ে সব জিনিসকে এক শ্রেণীতে জোর করে বাধা বর্বরতা ।” এই বলিয়া সমস্ত ফুলকে বন্ধনমুক্ত করিয়া ললিতা সেগুলিকে ঘরের এ দিকে, ও দিকে পৃথক করিয়া সাজাইল ; কেবল গোলাপ দুটিকে হাতে করিয়া লইয়া গেল। সতীশ ছুটিয়া আসিয়া কহিল, “দিদি, ফুল কোথায় পেলে ?” ললিতা তাহার উত্তর না দিয়া কহিল, “আজ তোর বন্ধুর বাড়িতে যাবি নে ?” বিনয়ের কথা এতক্ষণ সতীশের মনে ছিল না, কিন্তু তাহার উল্লেখমাত্রেই লাফাইয়া উঠিয়া কহিল, "হী যাব।” বলিয়া তখনই যাইবার জন্য অস্থির হইয়া উঠিল। ললিতা তাহাকে ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “সেখানে গিয়ে কী করিস ?” সতীশ সংক্ষেপে কহিল, “গল্প করি।” ললিত কহিল, “তিনি তোকে এত ছবি দেন, তুই তাকে কিছু দিস নে কেন ?” বিনয় ইংরেজি কাগজ প্রভৃতি হইতে সতীশের জন্য নানাপ্রকার ছবি কাটিয়া রাখিত। একটা খাতা করিয়া সতীশ এই ছবিগুলি তাঁহাতে গদ দিয়া আঁটিতে আরম্ভ করিয়াছিল। এইরূপে পাতা পুরাইবার জন্য তাহার নেশা এতইচড়িয়া গিয়াছে যে ভালো বই দেখিলেও তাহা হইতে ছবি কাটিয়া লইবার জন্য তাহার মন ছট্‌ফটু করিত। এই লোলুপতার অপরাধে তাহার দিদিদের কাছে তাহাকে বিস্তুর তাড়না সহ্য করিতে হইয়াছে। সংসারে প্রতিদান বলিয়া যে একটা দায় আছে সে কথাটা হঠাৎ আজ সতীশের সম্মুখে উপস্থিত হওয়াতে সে বিশেষ চিন্তিত হইয়া উঠিল। ভাঙা টিনের বাক্সটির মধ্যে তাহার নিজের বিষয়সম্পত্তি যাহা কিছু সঞ্চিত হইয়াছে, তাহার কোনোটারই আসক্তিবন্ধন ছেদন করা তাহার পক্ষে সহজ নহে। সতীশের উদবিগ্ন মুখ দেখিয়া ললিতা হাসিয়া তাহার গাল টিপিয়া দিয়া কহিল, “থাক থাক, তোকে আর অত ভাবতে হবে না। আচ্ছা, এই গোলাপ ফুল দুটাে তাকে দিস।” এত সহজে সমস্যার মীমাংসা হইল দেখিয়া সে উৎফুল্প হইয়া উঠিল। এবং ফুল দুটি লইয়া তখনই