পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (তৃতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গোরা 8br述 একটা বড়ো পুষ্করিণী ছিল— আহত ছেলেটিকে দুইটি ছাত্র ধরিয়া সেই পুষ্করিণীর তীরে রাখিয়া চাদর ছিডিয়া জলে ভিজাইয়া তাহার পা বাধিয়া দিতেছিল, এমন সময় হঠাৎ কোথা হইতে একটা পাহারাওয়ালা আসিয়াই একেবারে একজন ছাত্রের ঘাড়ে হাত দিয়া ধাক্কা মারিয়া তাহাকে অকথ্য ভাষায় গালি দিল । পুষ্করিণীটি পানীয় জলের জন্য রির্জাভ করা, ইহার জলে নামা নিষেধ, কলিকাতার ছাত্র তাহা জানিত না, জানিলেও অকস্মাৎ পাহারাওয়ালার কাছে এরূপ অপমান সহ্য করা তাহাদের | অভ্যাস ছিল না, গায়েও জোর ছিল, তাই অপমানের যথােচিত প্রতিকার আরম্ভ করিয়া দিল। এই দৃশ্য দেখিয়া চার-পাঁচজন কনস্টেবল ছুটিয়া আসিল । ঠিক এমন সময়টিতেই সেখানে গোরা আসিয়া উপস্থিত। ছাত্ররা গোরাকে চিনিত— গোরা তাহাদিগকে লইয়া অনেকদিন ক্রিকেট খেলাইয়াছে। গোরা যখন দেখিল ছাত্রদিগকে মারিতে মারিতে ধরিয়া লইয়া যাইতেছে, সে সহিতে পারিল না, সে কহিল, “খবরদার ! মরিস নে!” পাহারাওয়ালার দল তাহাকেও অশ্রাব্য গালি দিতেই গোরা ঘুষি ও লাথি মারিয়া এমন একটা কাণ্ড করিয়া তুলিল যে রাস্তায় লোক জমিয়া গেল। এ দিকে দেখিতে দেখিতে ছাত্রের দল জুটিয়া গেল। গোরার উৎসাহ ও আদেশ পাইয়া তাহারা পুলিসকে আক্রমণ করিতেই পাহারাওয়ালার দল রণে ভঙ্গ দিল। দর্শকরূপে রাস্তার লোকে অত্যন্ত আমোদ অনুভব করিল ; কিন্তু বলা বাহুল্য, এই তামাশা গোরার পক্ষে নিতান্ত তামাশা হইল না । বেলা যখন তিন-চারটে, ডাকবাংলায় বিনয় হারানবাবু এবং মেয়েরা রিহার্সালে প্রবৃত্ত আছে, এমন সময় বিনয়ের পরিচিত দুইজন ছাত্র আসিয়া খবর দিল, গোরাকে এবং কয়জন ছাত্রকে পুলিসে গ্রেফতার করিয়া লইয়া হাজতে রাখিয়াছে, আগামী কাল ম্যাজিষ্ট্রেটের নিকটে প্রথম এজলাসেই ইহার বিচার হইবে । গোরা হাজতে ! এ কথা শুনিয়া হারানবাবু ছাড়া আর-সকলেই একেবারে চমকিয়া উঠিল। বিনয় তখনই ছুটিয়া প্রথমে তাঁহাদের সহপাঠী সাতকড়ি হালদারের নিকট গিয়া তাহাকে সমস্ত জানাইল এবং তাহাকে সঙ্গে লইয়া হাজতে গেল । সাতকড়ি তাহার পক্ষে ওকালতি ও তাহাকে এখনই জামিনে খালাসের চেষ্টা করিবার প্রস্তাব করিল। গোরা বলিল, “না, আমি উকিলও রাখব না, আমাকে জামিনে খালাসেরও চেষ্টা করতে হবে N. " সে কী কথা ! সাতকড়ি বিনয়ের দিকে ফিরিয়া কহিল, “দেখেছি! কে বলবে গোরা ইস্কুল থেকে বেরিয়েছে ! ওর বুদ্ধিাশুদ্ধি ঠিক সেইরকমই আছে!” গোরা কহিল, “দৈবাৎ আমার টাকা আছে, বন্ধু আছে বলেই হাজত আর হাতকড়ি থেকে আমি খালাস পাব সে আমি চাই নে। আমাদের দেশের যে ধর্মনীতি তাতে আমরা জানি সুবিচার করার গরজ রাজার ; প্রজার প্রতি অবিচার রাজারই অধর্ম। কিন্তু এ রাজ্যে উকিলের কড়ি না জোগাতে পেরে প্রজা যদি হাজতে পচে, জেলে মরে, রাজা মাথার উপরে থাকতে ন্যায়বিচার পয়সা দিয়ে কিনতে যদি সর্বস্বাস্ত হতে হয়, তবে এমন বিচারের জন্যে আমি সিকি-পয়সা খরচ করতে চাই নে ৷” সাতকড়ি কহিল, “কাজির আমলে যে ঘুষ দিতেই মাথা বিকিয়ে যেত ।” গোরা কহিল, “ঘুষ দেওয়া তো রাজার বিধান ছিল না। যে কাজি মন্দ ছিল সে ঘুষ নিত, এ আমলেও সেটা আছে। কিন্তু এখন রাজদ্বারে বিচারের জন্যে দাড়াতে গেলেই, বাদী হােক প্রতিবাদী হােক, দোষী হােক, নির্দোষ হােক, প্ৰজাকে চোখের জল ফেলতেই হবে । যে পক্ষ নির্ধন, বিচারের লড়াইয়ে জিত-হার দুই তার পক্ষে সর্বনাশ । তার পরে রাজা যখন বাদী আর আমার মতো লোক প্রতিবাদী, তখন তার পক্ষেই উকিল ব্যারিস্টর- আর আমি যদি জোটাতে পারলুম তো ভালো, নইলে অদৃষ্ট যা থাকে! বিচারে যদি উকিলের সাহায্যের প্রয়োজন না থাকে। তবে সরকারি উকিল আছে কেন ? যদি প্রয়োজন থাকে তো গবর্মেন্টের বিরুদ্ধপক্ষ কেন নিজের উকিল নিজে জোটাতে বাধ্য হবে ? এ কি প্রজার সঙ্গে শত্রুতা ? এ কী রকমের রাজধর্ম ?” সাতকড়ি কহিল, “ভাই, চট কেন ? সিভিলিজেশন সস্তা জিনিস নয়। সূক্ষ্ম বিচার করতে গেলে