পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (ত্রয়োবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Տ Ֆb- 峰 রবীন্দ্র-রচনাবলী বনোয়ারি মিথ্যা তর্জন গর্জন করিল। কী জিনিস তাহার হারাইয়াছে তাহা ও সে বলিতে পারিল না এবং সেই চোরাই মাল সম্বন্ধে তাহার কোনো জোর নাই জানিয়া সে মনে মনে অসাবধান মূঢ় আপনাকেই যেন ছিন্ন ছিন্ন করিতে লাগিল । কাছারিতে এইরূপ পাগলামি করিয়া লে চাপাতলায় আবার খোজাখুজি করিতে লাগিল । মনে মনে মাতৃদিব্য করিয়া সে প্রতিজ্ঞা করিল, ‘যে করিয়া হউক এ কাগজগুলা পুনরায় উদ্ধার করিব তবে আমি ছাড়িব ।’ কেমন করিয়া উদ্ধার করিবে তাহা চিন্তা করিবার সামর্থ্য তাহার ছিল না, কেবল ক্রুদ্ধ বালকের মতো বারবার মাটিতে পদাঘাত করিতে করিতে বলিল, “উদ্ধার করিবই, করিবই, করিবই।” শ্রাস্তদেহে সে গাছতলায় বসিল । কেহ নাই, তাহার কেহ নাই এবং তাহার কিছুই নাই। এখন হইতে নিঃসম্বলে আপন ভাগ্যের সঙ্গে এবং সংসারের সঙ্গে তাহাকে লড়াই করিতে হইবে। তাহার পক্ষে মানসন্ত্রম নাই, ভদ্রতা নাই, প্রেম নাই, স্নেহ নাই, কিছুই নাই। আছে কেবল মরিবার এৰং মারিবার অধ্যবসায় । এইরূপ মনে মনে ছট্‌ফট্‌ করিতে করিতে নিরতিশয় ক্লাস্তিতে চাতালের উপর পড়িয়া কখন সে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। যখন জাগিয়া উঠিল তখন হঠাৎ বুঝিতে পারিল না, কোথায় সে আছে। ভালো করিয়া সজাগ হইয়া উঠিয়া বসিয়া দেখে তাহার শিয়রের কাছে হরিদাস বসিয় । বনোয়ারিকে জাগিতে দেখিয়া হরিদাস বলিয়া উঠিল, “জ্যাঠামশায়, তোমার কী হারাইয়াছে বলে দেখি ।” বনোয়ারি স্তব্ধ হইয়া গেল— হরিদাসের এ প্রশ্নের উত্তর করিতে পারিল না। হরিদাস কহিল, “আমি যদি দিতে পারি আমাকে কী দিবে।” বনোয়ারির মনে হইল, হয়তো আর-কিছু। সে বলিল, “আমার যাহা আছে সব তোকে দিব ।” এ কথা সে পরিহাস করিয়াই বলিল ; সে জানে, তাহার কিছুই নাই। তখন হরিদাস আপন কাপড়ের ভিতর হইতে বনোয়ারির রুমালে-মোড়া সেই কাগজের তাড়া বাহির করিল। এই রঙিন রুমালটাতে বাঘের ছবি আঁকা ছিল ; সেই ছবি তাহার জ্যাঠা তাহাকে অনেকবার দেখাইয়াছে । এই রুমালটার প্রতি হরিদাসের বিশেষ লোভ। সেইজন্যই অগ্নিদাহের গোলমালে ভূত্যের যখন বাহিরে ছুটিয়াছিল সেই অবকাশে বাগানে আসিয়া হরিদাস চাপাতলায় দূর হইতে এই রুমালটা দেখিয়াই চিনিতে পারিয়াছিল । হরিদাসকে বনোয়ারি বুকের কাছে টানিয়া লইয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিল ; কিছুক্ষণ পরে তাহার চোখ দিয়া ঝর ঝর করিয়া জল পড়িতে লাগিল। তাহার মনে