পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\S08 S রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী বালক নীরবে মাথা নাডিয়া জানাইল, “হা ।” সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কোন পুস্তক পড়িয়া থাক ?” নীলমণি পুস্তক শব্দের অর্থ না বুঝিয়া নিস্তব্ধভাবে ম্যাজিষ্ট্রেটের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল । ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের সহিত এই পরিচয়ের কথা নীলমণি অত্যন্ত উৎসাহের সহিত তাহার দিদির নিকট বৰ্ণনা করিলা । মধ্যাহ্নে চাপিকান প্যান্টলুন পাগডি পরিয়া জয়গোপাল ম্যাজিস্ট্রেটকে সেলাম করিতে গিয়াছে। অর্থী প্ৰত্যাখী চাপরাসী কনস্টেবলে চারি দিক লোকারণ্য । সাহেব গরমের ভযে তাম্বুর বাহিরে খোলা ছায়ায় ক্যাম্প টেবিল পাতিয়া বসিয়াছেন এবং জয়গোপালকে চৌকিতে বসাইয়া তাহাকে স্থানীয় অবস্থা জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন । জয়গোপাল তাহার গ্রামবাসী সর্বসাধারণের সমক্ষে এই গৌরবের আসন অধিকার করিয়া মনে মনে স্বকীত হইতেছিল এবং মনে করিতেছিল, “এই সময়ে চক্রবর্তীরা এবং নন্দীরা কেহ আসিয়া দেখিয়া যায় তো বেশ হয় ?” এমন সময় নীলমণিকে সঙ্গে করিয়া অবগুণ্ঠনাবৃত একটি স্ত্রীলোক একেবারে ম্যাজিস্ট্রেটের সম্মুখে আসিয়া দাড়াইল । কহিল, “সাহেব, তোমার হাতে আমার এই অনাথ ভাইটিকে সমর্পণ করিলাম, তুমি ইহাকে রক্ষা করো ।” সাহেব তাহার সেই পূর্বপরিচিত বৃহৎমস্তক গভীরপ্রকৃতি বালকটিকে দেখিয়া এবং স্ত্রীলোকটিকে ভদ্রস্ত্রীলোক বলিয়া অনুমান করিয়া তৎক্ষণাৎ উঠিয়া দাড়াইলেন, কহিলেন, “আপনি তাঁবুতে প্ৰবেশ করুন ||” স্ত্রীলোকটি কহিল, “আমার যাহা বলিবার আছে আমি এইখানেই বলিব ।” বলিয়া গেল। জয়গোপাল মধ্যে মধ্যে বাধা দিবার উপক্রম করাতে ম্যাজিস্ট্রেট রক্তবর্ণ মুখে গর্জন করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “চুপ রও !” এবং বোত্রাগ্র দ্বারা তাহাকে চৌকি ছাড়িয়া সম্মুখে দাড়াইতে জয়গোপাল মনে মনে শশীর প্রতি গর্জন করিতে করিতে চুপ করিয়া দাড়াইয়া রহিল । নীলমণি দিদির অত্যন্ত কাছে ঘেঁষিয়া অবাক হইয়া দাড়াইয়া শুনিতে লাগিল । র কথা শেষ হইলে ম্যাজিস্ট্রেট জয়গোপালকে গুটিকতক প্রশ্ন করিলেন এবং তাহার উত্তর শুনিয়া অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া শশীকে সম্বোধনপূর্বক কহিলেন, “বাছা, এ মকৰ্দমা যদিও আমার কাছে উঠিতে পারে না তথাপি তুমি নিশ্চিন্ত থাকো— এ-সম্বন্ধে যাহা কর্তব্য আমি করিব । শশী কহিল, “সাহেব, যতদিন নিজের বাড়ি ও না ফিরিয়া পায়, ততদিন আমার ভাইকে বাডি লইয়া যাইতে আমি সাহস করি না । এখন নীলমণিকে তুমি নিজের কাছে না। রাখিলে ইহাকে কেহ রক্ষা করিতে পরিবে না ।” সাহেব কহিলেন, “তুমি কোথায় যাইবে ?” শশী কহিল, “আমি আমার স্বামীর ঘাৱে ফিরিয়া যাইব, আমার কোনো ভাবনা নাই ।” সাহেব ঈষৎ হাসিয়া অগত্যা এই গলায়-মাদুলি-পরা কৃশকায় শ্যামবর্ণ গভীর প্রশান্ত মৃদুস্বভাব বাঙালির ছেলেটিকে সঙ্গে লইতে রাজি হইলেন । তখন শশী বিদায় লইবার সময় বালক তাহার আঁচল চাপিয়া ধরিল । সাহেব কহিলেন, “বাবা, তোমার কোনো ভয় নেই- এসো ।” ঘোমটার মধ্য হইতে আবিরল অশ্রঞ্চ মোচন করিতে করিতে শশী কহিল, “লক্ষ্মী ভাই, যা, ভাইআবার তোর দিদির সঙ্গে দেখা হবে ।”