পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VVo রবীন্দ্র-রচনাবলী যকৃৎ অম্লশূল এবং কনের জন্যে তো কাউকে খোজ করতে হয় না- তারা আপনি এসে চেপে ধরে, কিছুতে ছাড়তে চায় না । ܠ বাবার বুক দূরদূর করতে লাগল, মা দুৰ্গানাম জপ করতে লাগলেন । শহরের দেবতাকে পাড়াগায়ের পূজারি কী দিয়ে সন্তুষ্ট করবে। মেয়ের রূপের উপর ভরসা ; কিন্তু, সেই রূপের গুমর তো মেয়ের মধ্যে নেই, যে ব্যক্তি দেখতে এসেছে সে তাকে যে-দামই দেবে সেই তার দাম । তাই তো হাজার রূপে গুণেও মেয়েমানুষের সংকোচ কিছুতে ঘোচে না । সমস্ত বাড়ির, এমন-কি, সমস্ত পাড়ার এই আতঙ্ক আমার বুকের মধ্যে পাথরের মতো চেপে বসিল । সেদিনকার আকাশের যত আলো এবং জগতের সকল শক্তি যেন বারো বছরের একটি পাড়াগেয়ে মেয়েকে দুইজন পরীক্ষকের দুইজোড়া চোখের সামনে শক্ত করে তুলে ধরবার জন্যে পেয়াদাগিরি করছিল— আমার কোথাও লুকোবার জায়গা ছিল না । সমস্ত আকাশকে কঁাদিয়ে দিয়ে বঁাশি বাজতে লািগল— তোমাদের বাড়িতে এসে উঠলুম। আমার খুঁতগুলি সবিস্তারে খতিয়ে দেখেও গিন্নির দল সকলে স্বীকার করলেন, মোটের উপর আমি সুন্দরী বটে। সে কথা শুনে আমার বড়ো জায়ের মুখ গভীর হয়ে গেল । কিন্তু, আমার রূপের দরকার কী ছিল তাই ভাবি । রূপ-জিনিসটাকে যদি কোনো সেকেলে পণ্ডিত গঙ্গামৃত্তিকা দিয়ে গড়তেন, তা হলে ওর আদর থাকত ; কিন্তু, ওটা যে কেবল বিধাতা নিজের আনন্দে গড়েছেন, তাই তোমাদের ধর্মের সংসারে ওর দাম নেই । আমার যে রূপ আছে, সে কথা ভুলতে তোমার বেশিদিন লাগে নি । কিন্তু, আমার যে বুদ্ধি আছে, সেটা তোমাদের পদে পদে স্মরণ করতে হয়েছে। ঐ বুদ্ধিটা আমার এতই স্বাভাবিক যে তোমাদের ঘরকন্নার মধ্যে এতকাল কাটিয়েও আজও সে টিকে আছে। মা আমার এই বুদ্ধিটার জন্যে বিষম উদবিগ্ন ছিলেন, মেয়েমানুষের পক্ষে এ এক বালাই । যাকে বাধা মেনে চলতে হবে, সে যদি বুদ্ধিকে মেনে চলতে চায়। তবে ঠোকর খেয়ে খেয়ে তার কপাল ভাঙবেই । কিন্তু কী করব বলে । তোমাদের ফেলেছেন, সে আমি এখন ফিরিয়ে দিই। কাকে । তোমরা আমাকে মেয়ে-জ্যাঠা বলে দুবেলা গাল দিয়েছ। কটু কথাই হচ্ছে অক্ষামের সাত্মনা ; অতএব সে আমি ক্ষমা করলুম। আমার একটা জিনিস তোমাদের ঘরকন্নার বাইরে ছিল, সেটা কেউ তোমরা জান নি । আমি লুকিয়ে কবিতা লিখাতুম । সে ছাইপােশ যাই হােক-না, সেখানে তোমাদের অন্দরমহলের পাচিল ওঠে নি। সেইখানে আমার মুক্তি ; সেইখানে আমি আমি । আমার মধ্যে যা-কিছু তোমাদের মেজোবউকে ছাড়িয়ে রয়েছে, সে তোমরা পছন্দ কর নি, চিনতেও পার নি ; আমি যে কবি, সে এই পনেরো বছরেও তোমাদের কাছে ধরা পড়ে নি । তোমাদের ঘরের প্রথম স্মৃতির মধ্যে সব চেয়ে যেটা আমার মনে জাগছে সে তোমাদের গোয়ালঘর । অন্দরমহলের সিডিতে ওঠবার ঠিক পাশে ঘরেই তোমাদের গোরু থাকে, সামনের উঠোনটুকু ছাড়া তাদের আর নড়বার জায়গা নেই। সেই উঠোনের কোণে তাদের জাবনা দেবার কাঠের গামলা । সকালে বেহারিার নানা কাজ ; উপবাসী গোরুগুলো ততক্ষণ সেই গামলার ধারগুলো চোটে চোটে চিবিয়ে চিবিয়ে খাবলা করে দিত ।. আমার প্রাণ র্কাদত । আমি পাড়াগায়ের মেয়েতোমাদের বাড়িতে যেদিন নতুন এলুম সেদিন সেই দুটি গোরু এবং তিনটি বাছুরই সমস্ত শহরের মধ্যে আমার চিরপরিচিত আত্মীয়ের মতো আমার চোখে ঠেকল ।। যতদিন নতুন বউ ছিলুম নিজে না খেয়ে লুকিয়ে ওদের খাওয়াতুম ; যখন বড়ো হলুম। তখন গোরুর প্রতি আমার প্রকাশ্য মমতা লক্ষ করে আমার ঠাট্টার সম্পর্কীয়েরা আমার গোত্র সম্বন্ধে সন্দেহ প্ৰকাশ করতে লাগলেন । আমার মেয়েটি জন্ম নিয়েই মারা গেল । আমাকেও সে সঙ্গে যাবার সময় ডাক দিয়েছিল । সে যদি বেঁচে থাকত তা হলে সেই আমার জীবনে যা-কিছু বড়ো, যা-কিছু সত্য সমস্ত এনে দিতে ; তখন মেজেবিউ থেকে একেবারে মা হয়ে বসতুম । মা যে এক-সংসারের মধ্যে থেকেও বিশ্ব-সংসারের । মা