পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে Bra দূর করেছে নিজের লাঙলের চাষে ; পর্বতে অরণ্যে গুহাগহবরে সে বাস করতে পারত, করে নি-ই সে নিজের সুবিধা ও রুচি -অনুসারে আপনি বাসা আপনি নির্মাণ করেছে। পৃথিবীকে সে অযাচিত পেয়েছিল। কিন্তু, সে পৃথিবী তার ইচ্ছার সঙ্গে সম্পূর্ণ মিশ খায় নি ; তাই আদিকাল থেকেই প্রাকৃতিক পৃথিবীকে মানব বুদ্ধিকৌশলে আপনি ইচ্ছানুগত মানবিক পৃথিবী ক'রে তুলছে- সেজন্যে তার কত কলবল, কত নির্মাণনৈপুণ্য । এখানকার জলে স্থলে আকাশে পৃথিবীর সর্বত্র মানুষ আপনি ইচ্ছাকে প্রসারিত ক'রে দিচ্ছে । উপকরণ পাচ্ছে সেই পৃথিবীরই কাছ থেকে, শক্তি ধার করছে তারই গুপ্ত ভাণ্ডারে প্রবেশ করে । সেগুলিকে আপনি পথে আপন মতে চালনা ক’রে পৃথিবীর রূপান্তর ঘটিয়ে দিচ্ছে। মানুষের নগরপল্লী, শস্যক্ষেত্র, উদ্যান, হাট-ঘাট, যাতায়ার্তের পথ, প্রকৃতির সহজ অবস্থাকে। ছাপিয়ে স্বতন্ত্র হয়ে উঠছে। পৃথিবীর নানা দেশে ছড়ানো ধনকে মানুষ এক করেছে, নানা স্থানে বিক্ষিপ্ত শক্তিকে সে সংহত করেছে ; এমনি করে দেশ-দেশান্তরে পৃথিবী ক্রমশই অভিভূত হয়ে আত্মসমর্পণ করে আসছে মানুষের কাছে । মানুষের বিশ্বজয়ের এই একটা পালা বস্তুজগতে ; ভাবের জগতে তার আছে আর-একটা পালা । ব্যাবহারিক বিজ্ঞানে এক দিকে তার জয়স্তম্ভ, আর-এক দিকে শিল্পে সাহিত্যে । যেদিন থেকে মানুষের হাত পেয়েছে নৈপুণ্য, তার ভাষা পেয়েছে অর্থ, সেই দিন থেকেই মানুষ তার ইন্দ্ৰিবোধগম্য জগৎ থেকে নানা উপাদানে উদ্ভাবিত করছে তার ভাবগম্য জগৎকে । তার স্বরচিত। ব্যাবহারিক জগতে যেমন এখানেও তেমনি ; অর্থাৎ তার চার দিকে যা-তা যেমন- তেমন ভাবে রয়েছে। তাকেই সে অগত্যা স্বীকার করে নেয় নি । কল্পনা দিয়ে তাকে এমন রূপ দিয়েছে, হৃদয় দিয়ে তাতে এমন রস দিয়েছে, যাতে সে মানুষের মনের জিনিস হয়ে তাকে দিতে পারে আনন্দ । ভাবের জগৎ বলতে আমরা কী বুঝি । হৃদয় যাকে উপলব্ধি করে বিশেষ রসের যোগে ; অনতিলক্ষ্য বহু অবিশেষের মধ্য থেকে কল্পনার দৃষ্টিতে যাকে আমরা বিশেষ করে লক্ষ্য করি ; সেই উপলব্ধি করা, সেই লক্ষ্য করাটাই যেখানে চরম বিষয় । দৃষ্টান্তস্বরূপে বলছি, জ্যোৎজারাত্রি । সে রাত্রির বিশেষ একটি রস আছে, মনকে তা অধিকার করে । শুধু রস নয়, রূপ আছে তারা- দেখি তা কল্পনার চোখে । গাছের ডালে, বনের পথে, বাড়ির ছাদে, পুকরের জলে নানা ভঙ্গিতে তার আলোছায়ার কোলাকুলি । সেইসঙ্গে নানা ধ্বনির মিলন- পাখির বাসায় হঠাৎ "পাখা ঝাড়ার শব্দ, বাতাসে বঁাশপাতার ঝরঝরানি, অন্ধকারে আচ্ছন্ন ঝোপের মধ্য থেকে উঠছে ঝিল্লিধ্বনি, নদী থেকে শোনা যায় ডিঙি চলেছে তারই দাড়ের ঝাপ ঝাপ, দূরে কোন বাড়িতে কুকুরের ডাক । বাতাসে অদেখা অজানা ফুলের মৃদু গন্ধ যেন পা টিপে টিপে চলেছে, কখনো তারই মাঝে মাঝে নিশ্বসিত হয়ে উঠছে। জানা ফুলের পরিচয় । বহু প্রকারের স্পষ্ট ও অস্পষ্টকে এক ক’রে নিয়ে জ্যোৎস্নারাত্রির একটা স্বরূপ দেখতে পায় আমাদের কল্পনা দৃষ্টি । এই কল্পনাদৃষ্টিতে বিশেষ ক'রে সমগ্র করে দেখার জ্যোৎস্নারাত্রি মানুষের হৃদয়ের খুব কাছাকাছি জিনিস । তাকে নিয়ে মানুষের সেই অত্যন্ত কাছে পাওয়ার, মিলে যাওয়ার আনন্দ । গোলাপ-ফুল অসামান্য ; সে আপন সৌন্দর্যেই আমাদের কাছে বিশিষ্ট হয়ে ওঠে, সে স্বতই আমাদের মনের সামগ্ৰী । কিন্তু, যা সামান্য, যা অসুন্দর, তাকে আমাদের মন কল্পনার ঐক্যদৃষ্টিতে বিশিষ্ট করে দেখাতে পারে ; বাইরে থেকে তাকে আতিথ্য দিতে পারে ভিতরের মহলে । জঙ্গলে-আবিষ্ট ভাঙা মেটে পাচিলের গা থেকে বাগদি বুড়ি বিকেলের পড়ন্ত রৌদ্রে খুঁটে সংগ্রহ করে আপন বুড়িতে তুলছে, আর পিছনে পিছনে তার পোষা নেড়ি কুকুরটা লাফালাফি করে বিরক্ত করছে- এই ব্যাপারটি যদি বিশিষ্ট স্বরূপ নিয়ে আমাদের চোখে পড়ে, একে যদি তথ্যমত্রের মন্ত্র থেকে পৃথক করে এর নিজের অস্তিত্বক্টোরনে দেখি, তা হলে এও জায়গা নেবে ভাবের বস্তুত, আর্টিস্টরা বিশেষ আনন্দ পায় এইরকম সৃষ্টিতেই। যা সহজেই সাধারণের চোখ ভোলায় তাতে তার নিজের সৃষ্টির গীেরব জোর পায় না। যা আপনিই ডাক দেয় না তার মুখে সে আমন্ত্রণ