পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৫৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

কালান্তর Głąy সেইটেই হল সংগীত ; ঐ হুংকারটা হল শক্তি, এর পরিমাণ পাওয়া যায়, আর সংগীতটা হল অমৃত, হাতে বহরে ওকে কোথাও মাপাবার জো নেই। এই অমৃতের ক্ষেত্রে মানুষের অহংকারের স্রোত নিজের উলটাে দিকে, উৎসর্জনের দিকে । মানুষ আপনার দিকে কেবলই সমস্তকে টানতে টানতে প্ৰকাণ্ডতা লাভ করে, কিন্তু আপনাকে সমস্তর দিকে উৎসর্গ করতে করতে সে সামঞ্জস্য লাভ করে । এই সামঞ্জস্যেই শান্তি । কোনো বাহ্য ব্যবস্থাকে বিস্তীর্ণতর করার দ্বারা, শক্তিমানের সঙ্গে শক্তিমানকে জোড়া দিয়ে পুঞ্জীভূত করার দ্বারা, কখনোই সেই শান্তি পাওয়া যাবে না। যে-শান্তি সত্যে প্রতিষ্ঠিত, যে-শান্তি আলোভে, যে-শান্তি সংযমে, যে-শান্তি 3 প্রশ্ন তুলেছিলুম- আমার সত্তার পরমমূল্যটি কোন সত্যের মধ্যে। শক্তিময়ের শক্তিতে, না, उन्न्द्र उन्न् ? শক্তিকেই যদি সেই সত্য বলে বরণ করি তা হলে বিরোধকেও চরম ও চিরন্তন বলে মানতেই হবে য়ুরোপের অনেক আধুনিক লেখক সেই কথাই স্পর্ধাপূর্বক প্রচার করছেন । তারা বলছেন, শান্তির ধর্ম প্রেমের ধর্ম, দুর্বলের আত্মরক্ষা করবার কৃত্রিম দুৰ্গা ; বিশ্বের বিধান এই দুৰ্গকে খাতির করে না ; শেষ পর্যন্ত শক্তিরই জয় হয়- অতএব ভীরু ধর্মভাবুকের দল যাকে অধৰ্ম বলে নিন্দা করে, সেই অধর্মই কৃতাৰ্থতার দিকে মানুষকে নিয়ে যায়। অন্যদল সে কথা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে না ; সমস্ত মেনে নিয়েই তারা বলে : অধর্মেৈিণধতে তাবৎ ততো ভদ্রাণি পশ্যতি | ততঃ সপত্নান জয়তি সমূলন্ত বিনশ্যতি । ঐশ্বর্যগর্বেও মানুষের মন বাহিরের দিকে বিক্ষিপ্ত হয়, আবার দারিদ্র্যের দুঃখে ও অপমানেও মানুষের সমস্ত লোলুপ প্ৰবৃত্তি বাইরের দিকে ঝুকে পড়ে। এই দুই অবস্থাতেই মানুষ সকল দেবতার উপরে সেই শক্তিকে আসন দিতে লজ্জিত হয় না- যে ক্রুর শক্তির দক্ষিণহস্তে অন্যায়ের এবং বামহস্তে ছলনার অন্ত্র । প্রতাপসুরামত্ত যুরোপের পলিটিক্স এই শক্তিপূজা । এইজন্য সেখানকার ডিপ্লোমেসি কেবলই প্ৰকাশ্যতাকে এড়িয়ে চলতে চায় ; অর্থাৎ সেখানে শক্তি যে-মূর্তি ধারণ করেছে সে সম্পূর্ণ উলঙ্গামূর্তি নয় ; কিন্তু তার লেলিহান রসনার উলঙ্গতা কোথাও ঢাকা নেই। ঐ দেখো পীস-কনফারেন্সের সভাক্ষেত্রে তা লকলক করছে। অপর পক্ষে একদা আমাদের দেশে রাষ্ট্ৰীয় উচ্ছঙ্খলতার সময় ভীত পীড়িত প্ৰজা আপন কবিদের মুখ দিয়ে শক্তিরই স্তবগান করিয়েছে। কবিকঙ্কণচণ্ডী, অন্নদামঙ্গল, মনসার ভাসান, প্রকৃতপক্ষে অধর্মেরই জয়গান। সেই কাব্যে অন্যায়কারিণী ছলনাময়ী নিষ্ঠুর শক্তির হাতে শিব পরাভূত । অথচ অদ্ভুত ব্যাপার এই যে, এই পরাভবগানকেই মঙ্গলগান নাম দেওয়া হল । আজকের দিনেও দেখি আমাদের দেশে সেই হাওয়া উঠেছে । আমরা ধর্মের নাম করেই একদল লোক বলছি, ধর্মভীরুতাও ভীরুতা ; বলছি, যারা বীর, অন্যায় তাদের পক্ষে অন্যায় নয় । তাই দেখি সাংসারিকতায় যারা কৃতাৰ্থ এবং সাংসারিকতায় যারা অকৃতাৰ্থ, দুইয়েরই সুর এক জায়গা এসে মেলে । ধর্মকে উভয়েই বাধা বলে জানে- সেই বাধা গায়ের জোরে অতিক্রম করতে চায় । কিন্তু গায়ের জোরই পৃথিবীতে সব চেয়ে বড়ো জোর নয় । এই বড়ো দুঃসময়ে কামনা করি, শক্তির বীভৎসতাকে কিছুতে আমরা ভয়ও করব না, ভক্তিও করব না- তাকে উপেক্ষা করব, অবজ্ঞা করব । সেই মনুষ্যত্বের অভিমান আমাদের হােক, যে-অভিমানে মানুষ এই স্কুল বস্তুজগতের প্রবল প্ৰকাণ্ডতার মাঝখানে দাড়িয়ে মাথা তুলে বলতে পারে, আমার সম্পদ এখানে নয় ; বলতে পারে, শৃঙ্খলে আমি বন্দী হই নে, আঘাতে আমি আহত হই নে, মৃত্যুতে আমি মারি নে ; বলতে পারে যেনাহং নামৃতঃ স্যাম কিমহং তেন। কুর্যাম । আমাদের পিতামহেরা বলে গেছেন, এতদস্মৃতমভয়ং শান্ত উপাসীত- যিনি অমৃত, যিনি অভয় তাকে উপাসনা করে শান্ত হও । S SIS)"