পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৩২৬ রবীন্দ্র-রচনাবলী করিতে লাগিল যে, কোন প্রাচীন যুরোপীয় জ্ঞানী বলিয়াছেন Nature abhors vacuum— তাই তো দেখিতেছি । কিন্তু এটা কী রে! এটা কি Nature ? যদি আমাকে কিছু না বলে তবে আমি এখনি ইহাকে সমস্ত জায়গাটা ছাড়িয়া দিয়া লাফাইয়া পড়ি। লাফ দিতে সাহস হইল না— পাছে পিছনের দিক হইতে অভাবিতপূর্ব একটা কিছু ঘটে। ‘পাহারাওয়ালা বলিয়া ডাক দিবার চেষ্টা করিল— কিন্তু বহুকষ্টে এমনি একটুখানি অদ্ভূত ক্ষীণ আওয়াজ বাহির হইল যে, অত্যন্ত ভয়ের মধ্যেও তাহার হাসি পাইল । অন্ধকারে ময়দানের গাছগুলো ভূতের নিস্তব্ধ পার্লামেন্টের মতো পরস্পর মুখামুখি করিয়া দাড়াইয়া রহিল, এবং গ্যাসের খুটিগুলো সমস্তই যেন জানে অথচ কিছুই ষেন বলিবে না এমনিভাবে খাড়া হইয়া মিট্‌মিটে আলোকশিখায় চোখ টিপিতে লাগিল। মজুমদার মনে করিল, চট্‌ করিয়া এক লম্ফে সামনের আসনে গিয়া বসিবে। যেমনি মনে করা আমনি অনুভব করিল, সামনের আসন হইতে কেবলমাত্র একটা চাহনি তাহার মুখের দিকে তাকাইয়া আছে। চক্ষু নাই, কিছুই নাই, অথচ একটা চাহনি। সে চাহনি যে কাহার তাহ যেন মনে পড়িতেছে অথচ কোনোমতেই যেন মনে আনিতে পারিতেছে না। মজুমদার দুই চক্ষু জোর করিয়া বুজিবার চেষ্টা করিল— কিন্তু ভয়ে বুজিতে পারিল না— সেই অনির্দেশ্য চাহনির দিকে দুই চোখ এমন শক্ত করিয়া মেলিয়া রহিল যে, নিমেষ ফেলিতে সময় পাইল না। এ দিকে গাড়িটা কেবলই ময়দানের রাস্তার উত্তর হইতে দক্ষিণে ও দক্ষিণ হইতে উত্তরে চক্রপথে ঘুরিতে লাগিল। ঘোড়া দুটো ক্রমেই যেন উন্মত্ত হইয়া উঠিল— তাহাদের বেগ কেবলই বাড়িয়া চলিল— গাড়ির খড় খড়েগুলো থর্থর করিয়া কঁাপিয়া ঝরঝর শব্দ করিতে লাগিল । এমন সময় গাড়িটা যেন কিসের উপর খুব একটা ধাক্কা খাইয়া হঠাৎ থামিয়া গেল। মজুমদার চকিত হইয়া দেখিল, তাহাদেরই রাস্তায় গাড়ি দাড়াইয়াছে ও গাড়োয়ান তাহাকে নাড়া দিয়া জিজ্ঞাসা করিতেছে, “সাহেব, কোথায় যাইতে হইবে বলে ।” মজুমদার রাগিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “এতক্ষণ ধরিয়া আমাকে ময়দানের মধ্যে ঘুরাইলি কেন।” গাড়োয়ান আশ্চর্য হইয়া কহিল, “কই, ময়দানের মধ্যে তো ঘুরাই নাই।” মজুমদার বিশ্বাস না করিয়া কহিল, “তবে এ কি শুধু স্বপ্ন।” গাড়োয়ান একটু ভাবিয়া ভীত হইয়া কহিল, “বাবুসাহেব, বুঝি শুধু স্বপ্ন নহে। আমার এই গাড়িতেই আজ তিন বছর হইল একটা ঘটনা ঘটিয়াছিল।”