পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বিতীয় খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brS O রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী সন তারিখ মাস পার হয়ে আজও আমার মনে আছে । সেই দিনেই সোনার তরী কাব্যের সঞ্চার হয়েছিল মনে, তার প্রকাশ হয়েছিল কবে তা আমার মনেও নেই ; এইরকম অবস্থায় ইতিহাসের ভুল হবারই কথা । কারণ, আমার মনে সোনার তরীর যে ইতিহাসটা সত্য হয়ে আছে সেটা হচ্ছে সেই শ্রাবণ-দিনের ইতিহাস, সেটা কোন তারিখে লিখিত হয়েছিল সেইটেই আকস্মিক- সে দিনটা বিশেষ দিন নয়, সে দিনটা আমার স্মৃতিপটে কোনো চিহ্ন দিয়েই যায় নি। অতএব আমার দলিল আছে, আমার হাতে নেই । আদালতে তোমাদেরই জিৎ রইল । আমার দলিলের তারিখ কবিতার অভ্যন্তরেই আছে- ‘‘শ্রাবণ গগন ঘিরে ঘনমেঘ ঘুরে ফিরে” । তুমি বলবে ওটা কাল্পনিক, আমি বলব তোমাদের তারিখটা রিয়ালিস্টিক । বিরশি শান্তিনিকেতন গ্রন্থের ‘তরী বোঝাই। —শীর্ষক উপদেশ-ভাষণে রবীন্দ্ৰনাথ সোনার তরী কবিতার মর্মব্যাখ্যা করিয়াছেন সোনার তরী বলে একটা কবিতা লিখেছিলাম, এই উপলক্ষে তার একটা মানে বলা যেতে পারে । মানুষ সমস্ত জীবন ধরে ফসল চাষ করছে । তার জীবনের ক্ষেতটুকু দ্বীপের মতো- চারি দিকেই অব্যক্তের দ্বারা সে বেষ্টিত— ঐ একটুখানি তার কাছে ব্যক্ত হয়ে আছে- সেইজন্য গীতা বলেছেন অব্যক্তাদীনি ভুতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত । অব্যক্তনিধনান্যেবা তত্ৰ কা পরিদেবনা ৷ যখন কাল ঘনিয়ে আসছে, যখন চারি দিকের জল বেড়ে উঠছে, যখন আবার অব্যক্তের মধ্যে তার ঐ চারটুকু তলিয়ে যাবার সময় হল— তখন তার সমস্ত জীবনের কর্মের যা-কিছু নিত্য ফল তা সে ঐ সংসারের তরণীতে বোঝাই করে দিতে পারে । সংসার সমস্তই নেবে, একটি কণাও ফেলে দেবে না— কিন্তু যখন মানুষ বলে, ঐ সঙ্গে আমাকেও নাও, আমাকেও রাখো, তখন সংসার বলে, তোমার জন্যে জায়গা কোথায় — তোমাকে নিয়ে আমার হবে কী ! তোমার জীবনের ফসল যা-কিছু বাখবার তা সমস্তই রাখব, কিন্তু তুমি তো রাখবার যোগ্য নাও ! প্ৰত্যেক মানুষ জীবনের কর্মের দ্বারা সংসারকে কিছু-না-কিছু দান করছে, সংসার তার সমস্তই গ্রহণ করছে, রক্ষা করছে, কিছুই নষ্ট হতে দিচ্ছে না— কিন্তু মানুষ যখন সেইসঙ্গে অহংকেই চিরন্তন করে রাখতে চাচ্ছে তখন তার চেষ্টা বৃথা হচ্ছে । এই যে জীবনটি ভোগ করা গেল অহংটিকেই তার খাজনাস্বরূপ মৃত্যুর হাতে দিয়ে হিসাব চুকিয়ে যেতে হবে- ওটি কোনােমতেই জমাবার জিনিস নয় । {৪ চৈত্র ১৩১৫] —তরী বোঝাই । শান্তিনিকেতন রবীন্দ্ৰনাথ ছিন্নপত্রের একটি চিঠিতে ‘শৈশবসন্ধ্যা’ কবিতাটির যে ভাবব্যাখ্যা করিয়াছেন তাহা নিমো সংকলিত হইল সন্ধ্যাবেলায় পাবনা শহরের একটি খেয়াঘাটের কাছে বোট বাধা গেল । ও পার থেকে জনকতক লোক বায়াতবলার সঙ্গে গান গাচ্ছে, একটা মিশ্রিত কলরব কানে এসে প্ৰবেশ করছে ; কোঠাবাড়ি দেখা যাচ্ছে ; খেয়াঘাটে নানা শ্রেণী লোকের ভিড় । আকাশে নিবিড় একটা একরাঙা মেঘ, সন্ধ্যাও অন্ধকার হয়ে এসেছে ; ও পারে। সারবাধা মহাজনী নীেকায় আলো জ্বলে উঠল, পূজাঘর থেকে সন্ধ্যারতির কঁাসিরঘণ্টা বাজতে লািগল— বাতি নিবিয়ে দিয়ে বোটের জানলায় বসে আমার মনে ভারি একটা অপূর্ব আবেগ উপস্থিত হল । অন্ধকারের আবরণের মধ্যে দিয়ে