পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ ২১৭ মাছ ধরে, সেও বড়ে অপরূপ দৃশ্য। অন্য পক্ষে লাঠিখেলা কুস্তি নৌকোবাচ যাত্র শখের থিয়েটার এবং চারটে হাতির সমাবেশ এর কাছে লাগে কোথায় ? বিবাহের দুদিন আগে গায়ে-হলুদ। দামি গহনা থেকে আরম্ভ করে খেলার পুতুল পর্যন্ত সওগাত যা বরের বাসা থেকে এল তার ঘটা দেখে সকলে অবাক । তার বাহনই বা কত ! চাটুজ্যের খুব দরাজ হাতেই তাদের বিদায় করলে। অবশেষে জনসাধারণকে খাওয়ানো নিয়ে বৈবাহিক কুরুক্ষেত্রের দ্ৰোণপৰ্ব শুরু হল। সেদিন ঢোল পিটিয়ে সর্বসাধারণের নিমন্ত্রণ মধুসাগরের তীরে মধুপুরীতে। রবাহত অনাহূত কারও বাদ নেই। নবগোপাল রেগে আগুন। এ কী আস্পর্ধা ! আমরা হলুম জমিদার, এর মধ্যে উনি ওঁর মধুপুরী খাড়া করেন কোথা থেকে ? এ দিকে ভোজের আয়োজনটা খুব ব্যাপকরূপেই সকলের কাছে প্রকাশমান হয়ে উঠল। সামান্য ফলার নয়। মাছ দই ক্ষীর সন্দেশ ঘি ময়দা চিনি খুব শোরগোল করে আমদানি । গাছতলায় মস্ত মস্ত উনন পাত ; রান্নার জন্যে নানা আয়তনের হাড়ি হাড় মালসী কলসী জালা ; সারবন্দি গোরুর গাড়িতে এল আলু বেগুন কাচকলা শাকসবজি। আহারটা হবে সন্ধের সময় বাধা রোশনাইয়ের আলোয়। এ দিকে চাটুজ্যেদের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজন। দলে দলে প্রজারা মিলে নিজেরাই আয়োজন করেছে। হিন্দুদের মুসলমানদের স্বতন্ত্র জায়গা। মুসলমান প্রজার সংখ্যাই বেশি— রাত না পোয়াতেই তারা নিজেরাই রান্না চড়িয়েছে। আহারের উপকরণ যত না হোক, ঘন ঘন চাটুজ্যেদের জয়ধ্বনি উঠছে তার চতুগুণ। স্বয়ং নবগোপালবাবু বেল প্রায় পাচটা পর্যন্ত অভুক্ত অবস্থায় বসে থেকে সকলকে খাওয়ালেন। তার পরে হল কাঙালিবিদায়। মাতব্বর প্রজার নিজেরাই দানবিতরণের ব্যবস্থা করলে । কলধ্বনিতে জয়ধ্বনিতে বাতাসে চলল সমুদ্রমন্থন। মধুপুরীতে সমস্তদিন রান্না বসেছে। গন্ধে বহুদূর পর্যন্ত আমোদিত। খুরি ভাড় কলাপাত হয়েছে পর্বতপ্রমাণ। তরকারি ও মাছ কোটার আবর্জনা নিয়ে কাকেদের কলরবের বিরাম নেই– রাজ্যের কুকুরগুলোও পরস্পর কামড়াকামড়ি •চেঁচামেচি বাধিয়ে দিয়েছে। সময় হয়ে এল, রোশনাই জলছে, মেটিয়াবুরুজের রোশনচৌকি ইমনকল্যাণ থেকে কেদারা পর্যন্ত বাজিয়ে চলল। অনুচরপরিচরেরা থেকে থেকে উদ্বিগ্নমুখে রাজাবাহাদুরের কানের কাছে ফিস্ ফিস করে জানাচ্ছে এখনও খাবার লোক যথেষ্ট এল না। আজ হাটের দিন, ভিন্ন এলেকা থেকে যারা হাট করতে এসেছে তাদের কেউ কেউ পাত-পাড়া দেখে বসে গেছে। কাঙাল-ভিক্ষুকও সামান্ত কয়েকজন আছে।