পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যোগাযোগ २¢ १ চোখ কাউকে যেন সামনে থেকে দেখে না, অল্প একটু দেখে সমস্তটা দেখে নেয়। তার টসটসে ঠোটদুটির মধ্যে একটা ভাব আছে যেন অনেক কথাই সে চেপে রেখেছে। সংসার তাকে বেশি কিছু রস দেয় নি, তবু সে ভরা। সে নিজেকে দামি বলেই জানে, সে কৃপণও নয়, কিন্তু তার মহাৰ্য্যত ব্যবহারে লাগল না বলে নিজের আশপাশের উপর তার একটা অহংকৃত অশ্রদ্ধ। মধুসূদনের ঐশ্বর্ষের জোয়ারের মুখেই খাম৷ এ সংসারে প্রবেশ করেছে। যৌবনের জাদুমন্ত্রে এই সংসারের চূড়ায় সে স্থান করে নেবে এমনও সংকল্প ছিল। মধুসূদনের মন যে কোনোদিন টলে নি তাও বলা যায় না। কিন্তু মধুসূদন কিছুতেই হার মানল না ; তার কারণ, মধুসূদনের বিষয়বুদ্ধি কেবলমাত্র যে বুদ্ধি তা নয়, সে হচ্ছে প্রতিভা। এই প্রতিভার জোরে সম্পদ সে স্বষ্টি করেছে, আর সেই স্বষ্টির পরমানন্দে গভীর করে সে মগ্ন । এই প্রতিভার জোরেই সে নিশ্চয় জানত ধনস্থষ্টির যে তপস্যায় সে নিযুক্ত ইন্দ্রদেব - সেটা ভাঙবার জন্যে প্রবল বিঘ্ন পাঠিয়েছেন– ক্ষণে ক্ষণে তপোভঙ্গের ধাক্কা লেগেছে, বার বারই সে সামলে নিয়েছে। সুবিধা ছিল এই যে, ব্যবসায়ের ভরা মধ্যাহ্নে তার অবকাশমাত্র ছিল না। এই কঠিন পরিশ্রমের মাঝখানে চোখের দেখায় কানের শোনায় খামার যে সঙ্গটুকু নিঃসঙ্গভাবে পেত তাতে যেন মধুসূদনের ক্লাস্তি দূর করত। ক্রিয়াকর্মের পার্বণী উপলক্ষে খামান্বন্দরীর দিকে তার পক্ষপাতের ভারটা একটু যেন বেশি করে বুকত বলে বোঝা যায়। কিন্তু কোনোদিন খামাকে সে এতটুকু প্রশ্রয় দেয় নি অন্তঃপুরে যাতে তার স্পর্ধ বাড়ে। খাম৷ মধুসূদনের মনের ঝোকটা ঠিক ধরেছে, তবুও ওর সম্বন্ধে তার ভয় ঘুচল না। মধুসূদনের আহারের সময় স্যামামুন্দরী রোজই উপস্থিত থাকে ; আজও ছিল। সন্ত স্নান করে এসেছে— তার অসামান্ত কালে ঘন লম্ব চুল পিঠের উপর মেলেদেওয়া— তার উপর দিয়ে অমলণ্ডভ্র শাড়িটি মাথার উপর টেনে দেওয়া— ভিজে চুল থেকে মাথাঘষা মসলার মৃদু গন্ধ আসছে। দুধের বাটি থেকে মুখ না তুলে এক সময় আস্তে আস্তে বললে, “ঠাকুরপো, বউকে কি ডেকে দেব ?” মধুসূদন কোনো কথা না বলে তার ভাজের মুখের দিকে গম্ভীরভাবে চাইলে । তার ভাজ শু্যামাসুন্দরী ভয়ে থতোমতে খেয়ে প্রশ্নটাকে ব্যাখ্যা করে বললে, “তোমার খাবার সময় কাছে বসলে হয় ভালো, তোমাকে একটু সেবা করতে—” মধুসূদনের মুখের ভাবের কোনো অর্থ বুঝতে না পেরে খামান্বন্দরী বাক্য শেষ না করেই চুপ করে গেল। মধুসুদন আবার মাথা হেঁট করে আহারে লাগল।