পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৯ e রবীন্দ্র-রচনাবলী । কুমু ওর মুখের দিকে চেয়ে রইল— নীরব প্রশ্ন এই যে, ‘তুমি আগে বিছানায় যাবে না ? মধুসূদন দৃঢ়স্বরে পুনরায় বললে, “যাও, আর দেরি কোরো না।” কুমু বিছানায় যখন প্রবেশ করলে মধুসূদন সোফার উপরে বসে বললে, “এইখানেই বসে রইলুম, যদি আমাকে ডাক তবেই যাব । বৎসরের পর বৎসর অপেক্ষা করতে রাজি আছি।” কুমুর সমস্ত গ৷ এল ঝিম্ ঝিম্ করে— এ কী পরীক্ষা তার । কার দরজায় সে আজ মাথা কুটবে? দেবতা তো তাকে সাড়া দিলেন না। যে পথ দিয়ে সে এখানে এল সে তে একেবারই ভুল পথ। বিছানায় বসে বসে মনে মনে সে বললে, ঠাকুর, তুমি আমাকে কখনও ভোলাতে পার না, এখনও তোমাকে বিশ্বাস করব। ধ্রুবকে তুমিই বনে এনেছিলে, বনের মধ্যে তাকে দেখা দেবে বলে।’ সেই নিস্তব্ধ ঘরে আর শব্দ নেই ; রাস্তার মোড়ে সেই মাতালটার গলা শোনা যায় না ; কেবল সেই বন্দী কুকুরটা যদিও শ্রান্ত তবু মাঝে মাঝে আর্তনাদ করে উঠছে। , অল্প সময়কেও অনেক সময় বলে মনে হল, স্তব্ধতার ভারগ্রস্ত প্রহর যেন নড়তে পারছে না। এই কি তার দাম্পত্যের অনন্তকালের ছবি ? দু পারে দুজনে নীরবে বসে— রাত্রির শেষ নেই– মাঝখানে একটা অলঙ্ঘনীয় নিস্তব্ধতা ! অবশেষে এক সময়ে কুমু তার সমস্ত শক্তিকে সংহত করে নিয়ে বিছানা থেকে বেরিয়ে এসে বললে, “আমাকে অপরাধিনী কোরো না ।” মধুসূদন গম্ভীরকণ্ঠে বললে, “কী চাও বলে, কী করতে হবে?” শেষ কথাটুকু পর্যন্ত একেবারে নিংড়ে বের করে নিতে চায় । কুমু বললে, “শুতে এসে।” কিন্তু একেই কি বলে জিত ? ○ゲ পরের দিন সকালে মোতির মা যখন কুমুর জন্যে এক বাটি দুধ নিয়ে এল, দেখলে কুমুর দুই চোখ লাল, ফুলে আছে, মুখের রঙ হয়েছে পাশের মতো। সকালে ছাদের যে কোণে আসন পেতে পুব দিকে মুখ করে সে মানসিক পূজায় বসে, ভেবেছিল সেইখানে কুমুকে দেখতে পাবে। কিন্তু আজ সেখানে নেই, সিড়ি দিয়ে উঠেই যে একটুখানি ঢাকা ছাদ, সেইখানেই দেয়ালের গায়ে অবসন্নভাবে ঠেসান দিয়ে সে মাটিতে বসে। আজ বুঝি ঠাকুরের উপরে রাগ করেছে। নিরপরাধ ছেলেকে নিষ্ঠুর বাপ