পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

W98br রবীন্দ্র-রচনাবলী মাটির দিকেই নামিয়া আসি না কেন ? গুরুর চারিদিকে শিষ্য আসিয়া যেমন স্বভাবের নিয়মে বিশ্ববিদ্যালয় সৃষ্টি করিয়া তোলে, বৈদিককালে যেমন ছিল তপোবন, বীেন্ধকালে যেমন ছিল নালন্দা, তক্ষশিলাভারতের দুৰ্গতির দিনেও যেমন করিয়া টােল চতুস্পষ্ঠী দেশের প্রাণ হইতে প্ৰাণ লইয়া দেশকে প্রাণ দিয়া রাখিয়ছিল, তেমনি করিয়াই বিশ্ববিদ্যালয়কে জীবনের দ্বারা জীবলোকে সৃষ্টি করিয়া তুলিবার কথাই সাহস করিয়া বলা যাক-না কেন ? সৃষ্টির প্রথম মন্ত্ৰ- “আমরা চাই।' এই মন্ত্র কি দেশের চিত্তকুহর হইতে একেবারেই শুনা যাইতেছেন ? দেশের ধারা আচাৰ্য, যারা সন্ধান করিতেছেন, সাধনা করিতেছেন, ধ্যান করিতেছেন, তারা কি এই ময়ে শিষ্যদের কাছে আসিয়া মিলিবেন না ? বাষ্প যেমন মেঘে মেলে, মেঘ যেমন ধারাবর্ষণে ধারণীকে অভিষিক্ত করে তেমনি করিয়া কবে তারা একত্র মিলিবেন, কবে তাদের সাধনা মাতৃভাষায় গলিয়া পড়িয়া মাতৃভূমিকে তৃষ্ণার জলে ও ক্ষুধার অন্নে পূর্ণ করিয়া তুলিবে ? আমার এই শেষ কথাটি কেজো কথা নহে, ইহা কল্পনা । কিন্তু আজ পর্যন্ত কেজো কথায় কেবল জোড়াতাড়া চলিয়াছে, সৃষ্টি হইয়াছে কল্পনায়। SSS ছবির অঙ্গ এক বলিলেন বহু হইব, এমনি করিয়া সৃষ্টি হইল- আমাদের সৃষ্টিতত্ত্বে এই কথা বলে। একের মধ্যে ভেদ ঘটিয়া তবে রূপ আসিয়া পড়িল। তাহা হইলে রূপের মধ্যে দুইটি পরিচয় থাকা চাই, বহুর পরিচিয়, যেখানে ভেদ। এবং একের পরিচয়, যেখানে মিল। জগতে রূপের মধ্যে আমরা কেবল সীমা নয় সংযম দেখি । সীমাটা অন্য সকলের সঙ্গে নিজেকে তফাত করিয়া, আর সংযমটা অন্য সমস্তের সঙ্গে রফা করিয়া। রূপ এক দিকে আপনাকে মানিতেছে, আর-এক দিকে অন্য সমস্তকে মানিতেছে তবেই সে টিকিতেছে। তাই উপনিষৎ বলিয়াছেন, সূর্য ও চন্দ্ৰ, দুলোেক ও ভূলোক, একের শাসনে বিধৃত। সূৰ্য চন্দ্র দুঃলোক ভূলোক আপন-আপনি সীমায় খণ্ডিত ও বহু-কিন্তু তবু তার মধ্যে কোথায় এককে দেখিতেছি ? যেখানে প্ৰত্যেকে আপনি-আপিন ওজন রাখিয়া চলিতেছে ; যেখানে প্রত্যেকে সংযমের শাসনে নিয়ন্ত্রিত। ভেদের দ্বারা বহুর জন্ম কিন্তু মিলের দ্বারা বহুর রক্ষা। যেখানে অনেককে টিকিতে হইবে সেখানে প্রত্যেককে আপন পরিমাণটি রাখিয়া আপন ওজন বঁাচাইয়া চলিতে হয়। জগৎ সৃষ্টিতে সমস্ত রূপের মধ্যে অর্থাৎ সীমার মধ্যে পরিমাণের যে সংযম সেই সংযমই মঙ্গল সেই সংযমই সুন্দর। শিব যে যতী। আমরা যখন সৈন্যদলকে চলিতে দেখি তখন এক দিকে দেখি প্ৰত্যেকে আপনি সীমার দ্বারা স্বতন্ত্র আর-এক দিকে দেখি প্রত্যেকে একটি নির্দিষ্ট মাপ রাখিয়া ওজন রাখিয়া চলিতেছে। সেইখানেই সেই পরিমাণের সুষমার ভিতর দিয়া জানিইহাদের ভেদের মধ্যেও একটি এক প্রকাশ পাইতেছে। সেই এক যতই পরিস্ফুট এই সৈন্যদল ততই সত্য। বহু যখন এলেমেলো হইয়া ভিড় করিয়া পরস্পরকে ঠেলাঠেলি ও অবশেষে পরস্পরকে পায়ের তলায় দলাদলি করিয়া চলে। তখন বহুকেই দেখি, এককে দেখিতে পাই না, অর্থাৎ তখন সীমাকেই দেখি ভূমীকে দেখি না- অথচ এই ভূমীর রূপই কল্যাণরূপ, আনন্দরূপ। নিছক বহু কী জ্ঞানে কী প্রেমে কী কর্মে মানুষকে ক্লেশ দেয়, ক্লান্ত করে, এইজন্য মানুষ আপনার সমস্ত জানায় চাওয়ায় পাওয়ায় করায় বছর ভিতরকার এককে খুঁজতেছে- নহিলে তার মন মনে না, তার সুখ থাকে না, তার প্রাণধাঁচেনা। মানুষ তার বিজ্ঞানে বহুর মধ্যে যখন এককে পায় তখন নিয়মকে পায়, দর্শন বছর মধ্যে যখন এককে পায় তখন তত্ত্বকে পায়, সাহিত্যে শিল্পে বাহুর মধ্যে যখন এককে পায় তখন সৌন্দর্যকে পায়, সমাজে বহর মধ্যে যখন এককে পায় তখন কল্যাণকে পায়। এমনি করিয়া মানুষ রহকে লাইয়া তপস্যা করিতেছে এককে পাইবার জন্য।