পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (নবম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় ‹ላ S (፩ কেবল চােখে তাঁহাদের কাতরতা, এবং হৃদয়ের মধ্যে চিরপ্রচ্ছন্ন তুষের আগুন । সবই যে দুঃখের তাহা নহে, কিন্তু সকলেরই তো পরিণাম আছে। পরিণামের অর্থ- উৎসবের প্রদীপ নিবিয়া যাওয়া, বিসর্জনের পর মর্মভেদী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলা ! পরিণামের অর্থ- সূর্যালোক এক মুহূর্তের মধ্যে একেবারে স্নান হইয়া যাওয়া— সহসা জগতের চারি দিক সুখহীন, শান্তিহীন, প্রাণহীন, উদ্দেশ্যহীন মরুভূমি হইয়া যাওয়া ! পরিণামের অর্থ- হৃদয়ের মধ্যে কিছুতেই বলিতেছে না যে, সমস্তই শেষ হইয়া গেছে, অথচ চারি দিকেই তাহার প্রমাণ পাওয়া ; প্রতি মুহূর্তে প্রতি নূতন ঘটনায় অতি প্ৰচণ্ড আঘাতে নূতন করিয়া অনুভব করা যে, আর হইবে না, আর ফিরিবে না, আর সম্মুখে মাথা খুঁডিয়া মরিলেও সে একতিল উদঘাটিত হয় না ! মানুষে মানুষে চিরদিনের মিলন যে কী গুরুতর ব্যাপার তাহা সহসা সকলের মনে হয় না । তাহা চিরদিনের বিচ্ছেদের চেয়ে বেশি গুরুতর বলিয়া মনে হয় । আমরা অন্ধভাবে জগতের চারি দিক হইতে গড়াইয়া আসিতেছি, কে কোথায় আসিয়া পড়িতেছি। তাহার ঠিকানা নাই । যে যেখানকার নয় সে হয়তো সেইখনেই রহিয়া গেল। এ জীবনে আর তাহার নিস্কৃতি নাই। যাহা বাসস্থান হওয়া উচিত ছিল তাঁহাই কারাগার হইয়া দাড়াইল । আমরা সচেতন জড়পিণ্ডের মতো অহৰ্নিশি যে গড়াইয়া চলিতেছি- আমরা কি জানিতে পারিতেছি পদে পদে কত হৃদয়ের কত স্থান মাড়াইয়া চলিতেছি, আশে-পাশের কত আশা কত সুখ দলন করিয়া চলিতেছি ! সকল সময়ে তাহাদের বিলাপটুকুও শুনিতে পাই না, শুনিলেও সকল সময়ে অনুভব করিতে পারি না । না । তাহার কারণ, আমরা পরস্পরকে ভালো করিয়া বুঝিতে পারি না- দেখিতে পাই নাকোনখানে যে কাহার ঘাড়ে আসিয়া পড়িলাম জানিতেই পারি না। আমরা শৈলশিখরচ্যুত পাষাণখণ্ডের মতো । আমাদের পথে পড়িযা দুৰ্ভাগা ফুল পিষ্ট হইতেছে, লতা ছিন্ন হইতেছে, তৃণ শুষ্ক হইতেছে- আবার, হয়তো আমরা কাহার সুখের কুটিরের উপর অভিশাপের মতো পড়িয়া তাহার সুখের সংসার ছারখার করিয়া দিতেছি । ইহার কোনো উপায় দেখা যায় না। সকলেরই কিছু-না-কিছু ভার আছেই, সকলেই জগৎকে কিছু-না-কিছু পীড়া দেয়ই। যতক্ষণ তাহারা দৈবক্রমে তাঁহাদের ভারসহনক্ষম স্থানে তিষ্ঠিয়া থাকে ততক্ষণ সমস্ত কুশল, কিন্তু সময়ে সময়ে তাহারা এমন স্থানে আসিয়া পৌছায় যেখানে তাহদের ভার আর সয় না ! যাহার উপর পা দেয় সেও ভাঙিয়া যায়, আর অনেক সময় যে পা দেয় সেও পড়িয়া যায় |** হৃদয়ে যখন গুরুতর আঘাত লাগে তখন সে ইচ্ছাপূর্বক নিজেকে আরও যেন অধিক পীড়া দিতে চায়। এমন-কি, সে তাহার আশ্রয়ের মূলে কুঠারাঘাত করিতে থাকে। যে-সকল বিশ্বাস । তাহার জীবনের একমাত্র নির্ভর তাহাদের সে জলাঞ্জলি দিতে চায় ! নিষ্ঠুর তর্কদিগের ভয়ে যে প্রিয় বিশ্বাসগুলিকে সযত্নে হৃদয়ের অন্তঃপুরে রাখিয়া দিত। আজ অনায়াসে তাহাদিগকে তর্কে বিতর্কে ক্ষতবিক্ষত করিতে থাকে । প্রিয়বিয়োগে কেহ যদি তাহাকে সাস্তুনা করিতে আসিয়া বলে, “এত প্ৰেম, এত স্নেহ, এত সহৃদয়তা, তাহার পরিণাম কি ওই খানিকটা ভস্ম ! কখনোই নহে ।” তখন সে যেন উদ্ধত হইয়া বলে, “আশ্চর্য কি ! তেমন সুন্দর মুখখানি- কোমলতায় সৌন্দর্যোেলাবণ্যে হৃদয়ের ভাবে আচ্ছন্ন সেই জীবন্ত চলন্ত দেহখানি- সেও যে আর কিছু নয়, দুইমুঠ ছাইয়ে পরিণত হইবে, এই বা কে হৃদয়ের ভিতর হইতে বিশ্বাস করিতে পারিত। বিশ্বাসের উপরে বিশ্বাস কী !” এই বলিয়া সে বুক ফাটিয়া কঁাদিতে থাকে । সে অন্ধকার ৪০ ইহার পর পাণ্ডুলিপিতে অতিরিক্ত খানিকটা পাঠ দেখা যায়