পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (পঞ্চবিংশ খণ্ড) - বিশ্বভারতী.pdf/২৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SSや রবীন্দ্র-রচনাবলী ইঙ্গিতে আভাসে ফুরিত হয়েছে। কিন্তু একদিন একটি শহুরে ছেলের অভদ্রত। বেশ একটু গায়ে-পড়া হয়ে প্রকাশ পেল। সেটা অতীকের চোখে পড়তেই সেই ছেলেটাকে বিভার কাছে হিড় হিড়, করে টেনে নিয়ে এসে বললে, ‘মাপ চাও’ । মাপ তাকে চাইতেই হল নতশিরে অামত আমতা করে । তার পর থেকে অভক দায় নিল বিভার রক্ষাকর্তার। তা নিয়ে সে অনেক বক্রোক্তির লক্ষ্য হয়েছে, সমস্তই ঠিকরে পড়েছে তার চওড়া বুকের উপর থেকে। সে গ্রাহাই করে নি। বিভা লোকের কানাকানিতে অত্যন্ত সংকোচ বোধ করেছে কিন্তু সেই সঙ্গে তার মনে একটা রোমাঞ্চকর আনন্দও দিয়েছিল। বিভার চেহারায় রূপের চেয়ে লাবণ্য বড়ে । কেমন করে মন টানে ব্যাখ্যা করে বলা যায় না। অভীক ওকে একদিন বলেছিল, “অনাহতের ভোজে মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ । কিন্তু তোমার সৌন্দর্য ইতরজনের মিষ্টান্ন নয়। ও কেবল আর্টিস্টের ; লিওনার্ডে ডা ভিঞ্চির ছবির সঙ্গেই মেলে, ইনফ্লুটেবল ।” একদা কলেজের পরীক্ষায় বিভ। অভীককে ডিঙিয়ে গিয়েছিল, তা নিয়ে তার অজস্র কান্না আর বিষম রাগ। এ যেন তার নিজের অসম্মান। বললে, “তুমি দিনরাত কৈবল ছবি একে একে পরীক্ষায় পিছিয়ে পড়, আমার লজ্জা করে।” । কথাটা দৈবাং পাশের বারীন্দী থেকে কানে যেতেই বিভার এক সর্থী চোখ টিপে বলেছিল, “মরি মরি, তোমারি গরবে গরবিনী আমি, রূপসী তোমারি রূপে ।” অভীক বললে, “মুখস্থ বিদ্যার দিগগজের জানেই না আমি কোন মার্কাশূন্য পরীক্ষায় পাশ করে চলেছি। আমার ছবি অঁাকা নিয়ে তোমার চোখে জল পড়ে, আর তোমার শুকনো পণ্ডিতি দেখে আমার চোখের জল শুকিয়ে গেল। কিছুতেই বুঝবে না, কেননা তোমরা নামজাদ দলের পায়ের তলায় থাক চোখ বুজে, আর আমরা থাকি বদনামি দলের শিরোমণি হয়ে ।” এই ছবির ব্যাপারে দুজনের মধ্যে তীব্র একটা দ্বন্দ্ব ছিল। বিভ। অভীকের ছবি বুঝতেই পারত না সেকথা সত্যি। অন্য মেয়ের যখন ওর আঁকা যা-কিছু নিয়ে হই-হুই করত, সভা করে গলায় মাল পরাত, সেটাকে বিভ। অশিক্ষিতের ন্যাকামি মনে করে লজ্জা পেত। কিন্তু তীব্র ক্ষোভে ছট্‌ফট্‌ করেছে অতীকের মন বিভার অভ্যর্থনা না পেয়ে । দেশের লোকে ওর ছবিকে পাগলামি বলে গণ্য করছে, বিভাও যে মনে মনে তাদেরই সঙ্গে যোগ দিতে পারলে এইটেই ওর কাছে অসহ । কেবলই এই কল্পনা ওর মনে জাগে যে, একদিন ও যুরোপে যাবে আর সেখানে যখন জয়ধ্বনি উঠবে তখন বিভাও বসবে জয়মাল্য গাঁথতে ।